১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল শেষ রাতে কলকাতা প্রেস ক্লাব এবং হোটেল পার্কের সামনে থেকে কলকাতায় অবস্থিত ২০/২৫ জন দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার নিয়ে আমাদের এক অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। মুজিবনগর সরকারের তথ্য, সম্প্রচার ও বেতার অধিদপ্তরের পরিচালক (পরবর্তীতে চরমপত্র খ্যাত) এম আর আখতার মুকুলসহ আমি এবং আমাদের ফটোগ্রাফার আলমসহ আমরা তাদের সহযাত্রী হলাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের প থেকে সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কভার করার জন্য সেটা ছিল আমার প্রথম সরকারি assignment ২টি বাস ও কয়েকটি জীপে পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোড হয়ে কুষ্টিয়া সীমান্ত পার হয়ে সূর্য ওঠার আগেই আমরা মেহেরপুর মহকুমার কাছাকাছি পৌঁছলাম।
সেখানে যাবার পর জানতে পারলাম যে, কাছাকাছি কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি অনুষ্ঠান হবে। তখনও আমাদের প্রেস টিমের কেউ ঘূণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, ১৭৫৭ সালের ২২শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বাঙালীর যে স্বাধীনতার সূর্য পশ্চিম গগনে অস্তমিত হয়েছিল, তার থেকে কিছু দূরে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার পূর্ব গগনে উদিত হচ্ছে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে অর্থাৎ নির্দিষ্ট স্থানে যখন আমাদের প্রেস টিম পৌঁছালো তখন সেখানে দেবদারু পাতার তৈরী দুটি বড় বড় তোরণ দেখলাম। বঙ্গবন্ধুর হাতে আঁকা ছবি তোরণে ঝুলতে দেখলাম। কিছু দূরে দূরে মিত্র বাহিনীর এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট গান- এর পজিশন দেখলাম। এক ধরনের কমপে ৩০/৩৫টি এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট চোখে পড়ল। তবে আরও দূরে দূরে ভারতের মিত্র বাহিনীর বেশ কিছু ট্যাংকের পজিশন দেখতে পাওয়া গেল। তবে সেদিকে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের যাবার বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।
উল্লেখ্য যে, ১২ই এপ্রিল যশোরের চূয়াডাঙ্গায় এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রথম সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কলকাতায় পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে পাকিস্তানী বিমানবাহিনী চূয়াডাঙ্গায় ১২ই এপ্রিল ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। ভারত সরকার সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে মূলতঃ অন্ধকারে রেখে ১৭ই এপ্রিলের শপথ গ্রহণের কার্যক্রম গ্রহণ করে। ব্যতিক্রম শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ১৫ই এপ্রিল গভীর রাতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অবহিত করেন। বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার মাত্র আধা ঘন্টা পূর্বে জনাব মনসুর আলী, জনাব কামারুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী অবহিত করেন ও প্রায় তৎক্ষণাৎ জীপে তুলে নিয়ে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী সূত্র পরবর্তীতে প্রবাসী সরকারের মুখ্য সচিব আমার মামা রুহুল কুদ্দুসকে জানায় যে, বাংলাদেশের এমপি-দের অসর্তকতার ফলে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী চূয়াডাঙ্গার তথ্য জেনে যায়। সে কারণে, তাদেরকে অবহিত করা হয়নি বিধায় মেহেরপুরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ২/১ জন এমপি ব্যতীত আর কাউকে সেখানে দেখা যায়নি।
অঘোষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মেহেরপুরের দেড়/দুই হাজার লোক সমবেত হয়েছিলেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে একজন শ্বেত শুভ্র শশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধকে দেখলাম শোকাশ্রু নয়ন অথচ নির্মল হাসিমুখ। তাকে ঘিরে অনেকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছেন। আমিও ফটোগ্রাফার আলম তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে, তার কেমন লাগছে? তিনি কোন উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে আসমানের দিকে দু’হাত উঁচু করে বঙ্গবন্ধুর নাম করে জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলেন।
আরবী দোয়ার পরে বাংলায় বললেন, “…….. হে আল্লাহ পরওয়ার দেগার, তুমি আমাদের কলিজার টুকরা শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দাও। সে আমাদের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙ্গে আজাদ করে দিয়ে গেছে। হে পরওয়ার দেগার তুমি তাঁকে আজাদ করে দাও। আমরা তোমার জান্নাত চাই না। আমাদের জান্নাত, তোমার রহমান নামের নাম মুজিবুর রহমানকে আমাকে বুকে ফেরত এনে দাও।” তিনি মোনাজাত শেষ করে চোখ বন্ধ করে সকলকে বললেন, “আমার সাথে তোমরা সকলে তিনবার আমিন, আমিন, আমিন বলো।” সকলে বিমুগ্ধচিত্তে তার কন্ঠে কন্ঠস্বর মিলিয়ে আমিন বললো।
মেহেরপুরের সেই বৈদ্যনাথ তলায় একজন ছিন্ন বস্ত্রধারী সাধারণ কৃষাণীকে দেখলাম, এক কলসী কাঁখে গুড় এনেছে। সকলকে আদর সোহাগ করে ডেকে ডেকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। তার এই মিষ্টি খাওয়ানো দেখে অনেক হাসছিল! আমরাও কৌতুক মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলাম। অবহেলায় তার নামটাও জিজ্ঞেস করিনি! কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর মনে কত আফসোস হয়েছে! নিজেকে কতবার অভিশম্পাত দিয়েছি!! স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে আজও মনে খেদ রয়ে গেছে আমাদের সেই মহান বঙ্গজননীর জন্য। ছিন্ন বস্ত্র, হালকা-পাতলা, লম্বা দেহী, কপালে ভাঁজ পড়া চামড়া, শ্যামল বরণ ও মলিন বেশ! কিন্তু নির্মল পুণ্যময় হাসিভরা মুখ! সকলকে আদর সোহাগ করে কাছে ডেকে ডেকে গুড় দিয়ে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে!
তথ্য মন্ত্রণালয়ে কুষ্টিয়ার একজন মুক্তিযোদ্ধা তথ্য অফিসার ছিলেন হাফিজা আপা। পরবর্তীতে মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। তাকে বহুবার বলেছি। তিনিও মেহেরপুরে কয়েকবার গিয়ে সেই পুণ্যবতী মহিয়সী মায়ের সন্ধান আমাকে দিতে পারেননি। নিজেকে অনুকম্পায় দলিত-মথিত করে আজ বলি, “বাঙালী জাতির তাজমহলসম বাংলাদেশের পুণ্যময় জন্মলগ্নে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় কাঁখে গুড়ের কলসী থেকে হাসিমুখে নিজ হাতে সেখানে উপস্থিত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে আদর সোহাগ ভরে গুড় দিয়ে মিষ্টি মুখ করাচ্ছিলেন—বাঙালীর যে মহিয়সী জননী, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তোমার পরম স্নেহ-মমতার পুণ্যময় হাত যেন বাংলাদেশের ওপরে আশির্বাদের ছায়া হয়ে বিরাজ করে। তুমি সেই মহত্তম পুণ্যময়ী বঙ্গ জননী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার উদ্দেশ্যে লিখে রেখে গেছেন: “নম: নম: নম: বঙ্গজননী মম”।
ততক্ষণে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা জানতে পারলেন যে, ২/৩ মিনিটের মধ্যে একটি নব জাতির জন্ম হতে যাচ্ছে এবং তাদের চোখের সামনে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সকাল ১০টার মধ্যে বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে-লোকারণ্য হয়ে উঠল। তবে তাদের মধ্যে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যাই ছিল বেশী।
সকাল ১১টার মধ্যে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী প্রমুখ এলেন আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ১৭ই এপ্রিলের সকালে।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে বিশেষ একটি ঘটনা এখানে আমি উল্লেখ করছি। মেহেরপুরের আম্রকাননে যে মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের একটি বড় ধরনের জমায়েত হতে যাচ্ছে, সেটা ১৬ই এপ্রিল ভোরে সে এলাকার পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন এবং জামায়াত-মৌলবাদীরা কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিল। বিশেষ করে, ১৬ই এপ্রিল শেষ রাতের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মিত্র বাহিনীর সামরিক যান, এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট এবং কয়েক ডজন ট্যাংকের গর গর শব্দের আওয়াজ পেয়ে তারা মেহেরপুর এলাকা ছেড়ে যেতে থাকে। সেই সাথে রটিয়ে দিয়ে যায় যে, মেহেরপুরে হিন্দুদের একটা অনুষ্ঠান হবে এবং সেখানে পূজা পার্বন হবে। সেখানে কোন মোমিন-মুসলমান যাওয়া হারাম। সেখানে গেলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। এই ফতোয়া পেয়ে এলাকার মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম, মৌলভী, মাওলানা, ক্বারী, হাফেজ সব সকাল ৭/৮টার মধ্যে এলাকা ছাড়া হয়ে গেল। ফলে সকাল ১১টার দিকে যখন মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হবে, তখন সেখানে কোন ক্বারী, মৌলভী, মওলানা, হাফেজ, ইমাম, মোয়াজ্জেম বা কোন হুজুরকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সেই ক্রাইসিসের মধ্যে সে অনুষ্ঠানে কে পড়বে পবিত্র কোরান শরীফ? অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কথায় আমি ভিড়ের মধ্য থেকে ১৭/১৮ বছরের তরুণকে খুঁজে পেলাম। সুদর্শন কলেজের ফাষ্ট ইয়ারের ছাত্র বাকের আলী। তার মিষ্টি গলা, সে ভারি ভালো ক্বেরাত পড়তো। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী সেই ছেলেটিকে আমার হাত থেকে নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেনঃ “বাবা আল্লাহর নাম নিয়ে তুমি কোরান তেলাওয়াত করো। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন- বাংলাদেশের পুণ্য জন্মলগ্নে আল্লাহর পাক কালাম তেলাওয়াতের জন্য।”
বাকেরের বাড়ী মহেশনগর, বৈদ্যনাথতলা থেকে পৌনে এক মাইল দূরে। সে এসেছিল দলে বলে মিশে, কণ্ঠে কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে। এখন তারই সুরেলা কণ্ঠধ্বনিতে কোরান শরীফ তেলাওয়াত করতে হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হবে পবিত্র কোরান শরীফ তেলাওয়াতের মাধ্যমে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” গাওয়া হলো। অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করলেন। ২৬শে মার্চ ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করলেন। মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান এবং অর্থ মন্ত্রী জনাব মনসুর আলী শপথ গ্রহণ করলেন। এ সময় আকাশে একটু গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। যদিও সেটা মেঘের গর্জন ছিল এবং মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আশ-পাশ ঘিরে কয়েক মাইলব্যাপী ভারতের কয়েক শত এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট এবং দম দম এয়ারপোর্টে ভারতের কয়েক ডজন মিগ ফাইটিং এয়ার ক্রাফ্ট প্রস্তুত হয়ে ছিল। তথাপি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী স্যার ‘হারি আপ’, ‘হারি আপ’ বলে উঠলেন। তাঁর বলার অবশ্য কারণ ছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের পর সেখানে তাদেরকে অভিভাদন জানানোর দায়িত্ব দেয়া ছিল মেজর ওসমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দলকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি ও তার বাহিনী অনুষ্ঠানস্থলে সময়মত পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে মেঘের মধ্য থেকে গুড় গুড় আওয়াজ শোনা যাওয়ায় শংকিত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী হুকুম দিলেন সেখানে উপস্থিত এস.পি. মাহবুবের নেতৃত্বে নব গঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানাতে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.পি. মাহাবুব সেখানে যেসব আনসার ছিল, তাদেরকে নিয়ে তিনি সামরিক কায়দায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মঞ্চে দন্ডায়মান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অভিবাদন জানানোর জন্য মার্চ পাষ্ট করে মঞ্চের পাশ ঘেঁষে তাদেরকে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে যান। মঞ্চে দন্ডায়মান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তার পাশে দন্ডায়মান প্রধানমন্ত্রী এবং তার পেছনে দন্ডায়মান প্রধান সেনাপতি মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে সেই অভিভাদন গ্রহণ করেন।
অভিবাদন শেষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কয়েক ডজন দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে নব জন্ম লাভকারী জাতির কান্ডারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেনঃ “আজ এই আম্রকাননে একটি নূতন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বৎসর যাবত বাংলার মানুষ, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানী হানাদারদেরকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই। আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তাঁর নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নূতন রাষ্ট্রের সূচনা হল তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। আপনারা জেনে রাখুন গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থবাদী শিল্পপতি পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপোষ নেই, মা নেই।
আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।”
শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ও দেশী বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে মুহুর্মুহু “জয় বাংলা” ও “জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনির মধ্যে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে তথা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে তিনিও ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি বলেনঃ
“বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তাঁরা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাঙ্খাকে সত্যিকার ভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন।”
বাংলাদেশের বুকে এহিয়া খানের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোন-মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর ল্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মত। তারা চালিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজীর নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারতো না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণ-হত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানে বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালীর রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়।”
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আরও বলেন, “হিটলারের পর গণহত্যার এমন জঘণ্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উট পাখীর নীতি অনুসরণ করেছিল। তাঁরা যদি মনে করে থাকেন যে এতদ্বারা তাঁরা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তা’হলে তাঁরা ভুল করেছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাঁদের বুঝা উচিত যে পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এই নূতন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নূতন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নূতন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।”
তিনি সুস্পষ্ট করে আরও বলেন, “সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা’ আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাবো। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।”
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভস্ম ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নূতন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দুরূহ বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে। আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না। আমাদের এই অস্তিত্ব রার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না–আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারো তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ছ’দফার আলোকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ছ’দফা নির্বাচনী ইশতাহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের স্থলে মোট ১৬৭টি আসন লাভ করছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে আওয়ামী লীগ শতকরা আশিটি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
স্বভাবতঃই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে এবার ছ’দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ছ’দফাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কাজেই ছ’দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্য জনগণের কাছে এই দল জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ছ’দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ছ’দফার আলোকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ’৭০-এর নির্বাচন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে জাতীয় পরিষদ আহবানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আলোচনায় বসবে। এমনি আলোচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সব সময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য গোপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্ত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে গেল এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রয়োগের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখল।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলোচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ’৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ছ’দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফল কি হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তাঁর নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ছ’দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টির সাথে একটি সমঝোতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন। পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭শে জানুয়ারী, ’৭১ জনাব ভুট্টো এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের ওপর আলোচনার জন্য এ সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামো সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তাঁর দল ছ’দফার বাস্তব ফল কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না-সূচক, এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোনও তৈরী বক্তব্য ছিল না, সেহেতু, এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপোষ ফরমুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সব সময়ই খোলা ছিল। এই আলোচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে কোন পর্যায় থেকে আপোষ ফরমুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোন বক্তব্য ছিল না।
এখানে একটি কথা আরো পরিষ্কার ভাবে বলে রাখা দরকার যে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোনও আভাসও পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে আলোচনার জন্য সব দরজাই খোলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার পর পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরো অধিক ফলপ্রসূ আলোচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদেও তারা ভিন্নভাবে আলোচনার জন্যও অনেক সুযোগ পাবেন।
পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এ জন্যই সবাইকে আরো বেশী বিস্মিত করে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দাবী মোতাবেক ১৫ই ফেব্র“য়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথা মতই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লেঃ জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লেঃ জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পি. পি. পি. ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিমানে পূর্ব বাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে পি.পি.পি.-র বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোন কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ১লা মার্চ অনির্দিষ্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর সহযোগী চক্রান্তকারী ভুট্টোকে খুশী করার জন্য। শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলায় গভর্ণর আহসানকে বরখাস্ত করলেন। গভর্ণর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যজীবী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালীদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারী জান্তার হাতে তুলে দেয়া হলো।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোন ক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারতো এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারতো। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার মতার উৎস না করে একটা ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত করার।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে পড়েন। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন যে মতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারী রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এক পাকিস্তানের কাঠামোতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালী শিা গ্রহণ করেছে। তাই তারা এক বাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এতদ্সত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩রা মার্চ অসহযোগ কর্মসূচির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনো তিনি আশা করছিলেন যে সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২রা ও ৩রা মার্চ ঠান্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলী করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নূতন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরী অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নূতন গভর্ণর লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সহ গণ প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারীগণ তাঁদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেই তাঁরা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরা সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তাঁরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারো নির্দেশ মেনে চলবেন না।
এ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশে কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছা-সেবকগণ আইন শৃংখলা রার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর কৌশল পাল্টালেন। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেননা তাঁর ঐদিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকায় সেনাবাহিনীকে করা হয় পুর্ণ সতর্কীকরণ। লেঃ জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানো হলো লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে, শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয় তার শেষ সুযোগ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেেিত এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তি-পূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র ল্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে অনুরূপ একটি সঙ্কট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল।
১লা মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাঙ্কগুলো ফেরত আনা হয়। ১লা মার্চ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লোকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
১লা মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পি-আই-এর কমার্শিয়াল ফাইটে সাদা পোষাকে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হল। সি ১৩০-পরিবহন বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তুপীকৃত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গিয়াছে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম সহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানী করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমান বন্দরকে বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় আর্টিলারী ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এস-এস-জি কমান্ডো গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকান্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংগঠন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণা বা ভণ্ডামীর এই ষ্ট্রাটেজী গোপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনায় আপোষমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ই মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কি? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোন আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে ৪ দফা শর্ত পূরণ ভিত্তিতে উভয় পরে উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনাকালে যে সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলি হল :
১। মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বোমরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
২। প্রদেশগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
৪। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণ পৃথক পৃথক ভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোরঞ্জনের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলো বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীল নক্সা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী এম. এন. এ.-দের পৃথকভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নূতন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হলো অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মতা বন্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই অংশটি সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরীর উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের এহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম. এম. আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ কথা বলেন যে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লঙ্ঘ্য কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে একথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন্ শব্দ বসবে সে নিয়ে। ২৪শে মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিষ পরিষ্কার করে বলতে হয়, কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোন কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
২৫শে মার্চের গণহত্যাকে ধামা-চাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও এহিয়া জোচ্চুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে বৃটিশ সরকার কর্তৃক যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল, তিনিও সেভাবে একটা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছিলেন, ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার–ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও একথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করতো না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বানচাল করতে দেয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশী করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম.এম. আহমদ তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট এহিয়া ও জনাব এম.এম. আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫শে মার্চ করাচী চলে গেলেন।
২৫শে মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের ঘুমন্ত শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হল গণহত্যার এক পূর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান, আর্টিলারী সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারী করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। যা বিশ্বের সকল সভ্য দেশে সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক, যাতে জনগণ আত্মরক্ষা করতে পারে। পরদিন সকালে লেঃ জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারী করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুন্ডে। প্রতিটি অলিগলি ও আনাচে কানাচে চলতে লাগলো নির্বিচারে গুলী। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের মুখে রাতের অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যেসব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হল মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ই পি আর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারলো না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এহিয়া খানের নির্দেশে পাক সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, আমরা তার নির্ভরযোগ্য তালিকা ৩০ লাখ বলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ১৯৭৪ সালে লিপিবদ্ধ করা হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেসব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে “অপারেশন সার্চ লাইট” সাংকেতিক নামে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালী হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো এর কৈফিয়ত। রেডিও-টিভিতে দেয়া ভাষণে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংঘটনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পর বিরোধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপুর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলোচনায় কোন সংগতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারলো না। তার বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গী আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
নবগঠিত সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রধান সেনাপতির ভাষণ এবং মুক্তিবাহিনী ও আনসার বাহিনীর স্যালুট প্রদান এবং প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে শেষ হলো সেই ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান।
১৭ এপ্রিল দুপুর থেকে আকাশবাণী, বি বি সি সহ বিশ্বের গণমাধ্যম সমূহে যখন প্রচারিত হয়ে গেল যে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে, মেহেরপুরে, স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হয়েছে ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এলো পাক হানাদারেরা মেহেরপুরের দিকে।
কিন্তু সেই মেহেরপুরের কেয়ামতের দিন এলো ২৭শে এপ্রিল। পাক আর্মির বিরাট বাহিনী কামান ও অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে চূয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-মোনাখালী দিয়ে ঢুকে মহিষনগর, গোপালনগর, আনন্দবাগের দিকে বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে ছুটে আসে। বৈদ্যনাথতলা, তথা মুজিবনগর ছিল মহেশনগরের আধা মাইলের মধ্যে। হানাদারেরা মোনাখালী থেকে আরম্ভ করে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত ৮-১০ মাইলব্যাপী কামানের গোলা ও মেশিনগানের গুলি শিলাবৃষ্টির মতো বর্ষণ করলো। এ সব এলাকার বাড়ী ঘরে, আগুন লাগিয়ে দিলো। মেহেরপুর কোর্টে একটা এলাকায় কয়েক ডজন লোক জড়ো করে বড় গর্ত খুঁড়ে গুলী করে হত্যা করে তাঁদেরকে গর্তে ফেলে। তাদের মধ্যে চূয়াডাঙ্গার দারোগা আইয়ুবও ছিল। চূয়াডাঙ্গা রেল ষ্টেশন থেকে একটু দূরে তিন/চারটা ঘরে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেককে সেখানে গুলী করে মারে। যুদ্ধের পর সেখানে ঘরের মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে গেছে দেখা যায়। ঘরের দেয়ালে সব রক্ত ছিটিয়ে আছে। আনুমানিক ৫০/৬০ জন লোককে পাক হানাদাররা ২৭শে এপ্রিল চূয়াডাঙ্গার ঐ অভিশপ্ত ঘরে মারে। দরিয়াপুর গ্রামের ডাঃ শামসুল হুদার বাড়ীর কৃষককে আর বাচ্চাদের চুল চেপে ধরে, মাটিতে আছড়ে আছড়ে মারে পাকিস্তানী সীমারেরা।
আর সেই বেচারা বাহারউদ্দীনের ভাতিজা ১৭/১৮ বছরের বাকের, যার মিষ্টি কণ্ঠের কোরান তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সূর্য বঙ্গ জননীর মুখে ১৭ই এপ্রিলের সকালে প্রথম আলোক রশ্মি ফেলেছিল- তার ভাগ্যে কি হয়েছিল?
স্বাধীনতার সুবাদে যারা বঙ্গভবনের শীর্ষে, পতাকা উড়ানো গাড়ীতে, সচিবালয়ের সচিব, মতিঝিলের কোটিপতি, গুলশান-বনানী-বারিধারার শ্বেত পাথরের সুরম্য অট্টালিকার মালিক-তারা কেউ তার খোঁজ নেননি! অথচ স্বাধীনতা না হলে কারো গাড়ীতে, বাড়ীতে পতাকা উঠতো না, অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের লেজা হয়ে জীবন কাটাতেন এবং মতিঝিলের বর্তমানের কোটিপতিরা ’৭১-এর পূর্বের ন্যায় বাওয়ানী-আদমজী-ইস্পাহানী ও অন্যান্য পাকিস্তানী ব্যবসায়ীর মাথায় ছাতা ধরে ও তাদের ব্যাগ টেনে টেনে জীবনপাত করতেন।
মহেশনগরের গরীব কৃষকের ১৫/১৬ বছরের তরুণ সেই বাকেরকে পবিত্র কোরান শরীফ তেলাওয়াতের অপরাধে পাকিস্তানী খান সেনারা ধরে তাকে প্রথমে বলেঃ “তুই মুসলমান? খোল্ লুঙ্গি। তোর পুরুষাঙ্গ দেখা, মুসলমানি দেয়া আছে কি না দেখা?”
তারপর তাকে আমগাছের গুঁড়িতে দড়ি দিয়ে পেচিয়ে বেঁধে ফেলে। আমগাছে বাঁধা অবস্থায় অসহায় বাকেরের শরীর ছুরি দিয়ে চিরে চিরে লবণ ও ঝালের গুঁড়ো ঢেলে দেয় হিংস্র পাকিস্তানী খান সেনারা। তার অপরাধ, কেন সে কোরান শরীফ পড়লো। গাছের গুঁড়িতে বেড় দিয়ে হাত, পা, শরীর বাঁধা অবস্থায় কোরান শরীফের যত ছুরা ও আয়াত জানে সব চীৎকার করে পড়ে যায় বাকের! কিন্তু হায়! গলেনি মন সেই পাকিস্তানী কাফেরদের, যারা মুখে বলে মুসলমান কিন্তু কোরান শরীফ পড়াকে বলে অপরাধ।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যত চীৎকারে বালক বাকের কোরান শরীফ পড়ুকনা কেন, পাকিস্তানী খানসেনারা তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। জামাতীদের দ্বারা বিভিন্ন গাছ থেকে শত শত পিঁপড়ার বাসা ভেঙ্গে আনায় তারা। সে সব পিঁপড়ার বাসার লাখ লাখ পিঁপড়া ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলে সেই যন্ত্রণাকাতর বাকেরের মাথায়, মুখে, গায়, সর্ব অঙ্গে। পিঁপড়ার ওপরে পিঁপড়ায় তার শরীর ঢেকে যায়। এক সময় তাকে আর দেখা যায় না, সেখানে দেখা যায় পিঁপড়ার গুদাম।
পাকসেনারা চীৎকার করে বলে, “তুঝে গুলিসে নেহি মারুঙ্গা। বুলকে চুটিওসে খেলাওঙ্গা”। (তোকে গুলী করে মারবো না। তোকে পিঁপড়া দিয়ে খাইয়ে মারবো।) বলতে থাকে আর পিঁপড়ার বাসা তার গায়ের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকে। এভাবে দু’ঘন্টা সেই নিষ্ঠুর অত্যাচারের পর বাকের যখন নির্জীব হয়ে পড়ে, তখন সে মারা গেছে ভেবে খানসেনারা অন্য দিকে হামলা করার জন্য যায়।
খানসেনারা অন্যদিকে চলে গেলে সেই সুযোগে গ্রামের দুঃসাহসী যুবকেরা এসে বাঁধন খুলে বাকেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মগোপন করে। তখন তারা দেখতে পায় যে, বাকেরের মাথায় ও গায়ে পাকিস্তানী খান সেনারা পিঁপড়ার শত শত বাসা ভেঙে ভেঙে লাখ লাখ পিঁপড়া ঢেলে দিলেও পিঁপড়া তাকে কামড়ায়নি। পিঁপড়ার কামড়ের একটা দাগও বাকেরের শরীরে নেই দেখে এই অলৌকিক ঘটনায় সকলে বিস্মিত হয়ে পড়ে!
আল্লাহ’র অবলা পিপীলিকা পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী বাকেরের পুণ্য শরীরে একটিবার কামড় দেয়নি, আর ইসলামের নামে এক লাখ পাকিস্তানী হানাদার বাংলাদেশে ৩০ লাখ ভাই বোনকে হত্যা করেছে, ৩ লাখ মা বোনকে ধর্ষণ করেছে। যে পাকিস্তানী সেনারা গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছো, তারা শুনে রাখো, তোমরা কাফির, কাফির, কাফির। তোমাদের পক্ষে ’৭১-এ আল্লাহ ছিলেন না, কেয়ামতের দিনেও থাকবেন না। কেয়ামতের দিনে তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে হাবিয়া দোজখ।
’৭১-এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী ছাত্র বাকের স্বাধীনতার পর বহু কষ্টে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স পর্যন্ত পড়েছিল। কিন্তু তার গরীব কৃষক বাবা তাকে এম. এ. পড়াবার খরচ আর চালাতে পারেনি। তারপর দ্বারে দ্বারে সে ঘুরেছে, সামান্য একটি চাকরির জন্য। কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে একটি চাকুরি দিয়ে সাহায্য করতে।
যখন এদেশের পরাক্রমশালী সামরিক প্রেসিডেন্টদের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ভেজিটেবলস্ আনা হতো, ফ্রান্স থেকে আঙ্গুর, স্পেন থেকে আপেল, তখন দ্বারে দ্বারে ভিখারীর মতো ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে গেছে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধা বাকের!
’৭১ সালের ১০ই এপ্রিল শনিবার বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে আকাশবানী বিবিসিসহ বিশ্বের সকল প্রচার মাধ্যমে ১০ই এপ্রিল দুপুরে এ সংবাদ প্রচারিত হয়ে যায়। ঐদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য “জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি ভাষণ” বিকেলে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু ১০ই এপ্রিল দুুুপুরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নাম বিশ্বব্যাপী ইথারে প্রচারিত হয়ে যাবার সাথে সাথে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে বিভেদের ও চক্রান্তের সুর বেজে ওঠে। চক্রান্তকারীদের মধ্যমণি ছিল খোন্দকার মোশতাক। ১০ই এপ্রিল সন্ধ্যা না গড়াতে সেখানে ২/৩ জন প্রধানমন্ত্রীর দাবীদার হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্কট ও চক্রান্তের মধ্যে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য বিএসএফ-এর মহাপরিচালক গোলক মজুমদারের হাতে বিকেলে হস্তান্তর করে দেন। কিন্তু সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ চক্রান্তের গভীরতা আঁচ করতে পারেন এবং তার ওপর খোন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগী ছাত্র নেতাদের চাপ বেড়ে যায়। তখন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর ভাষণ” প্রচার স্থগিত রাখতে বলেন।
কিন্তু ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাকে জানান যে, তার রেকর্ডকৃত ভাষণ তিনি বিএসএফ-এর গোলক মজুমদারের হাতে বিকেলে হস্তান্তর করে দিয়েছেন এবং সেটা ফিরিয়ে আনা বা ফিরিয়ে আনতে বলার আর কোন সুযোগ নেই। কেননা, স্বাধীন বাংলা বেতারের ট্রান্সমিটার ছিল সমুদ্রে চলমান একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে। উপকূল থেকে নৌবাহিনীর ছোট জলযানে সেটা উক্ত জাহাজে পৌঁছানো হতো। কমবেশি ৪ ঘন্টা সময়ে প্রবাসী সরকারের অবস্থান স্থল থেকে যে কোন রেকর্ড পৌঁছাতে সময় লাগতো। সুতরাং সেটা বন্ধ করার সকল পথ রুদ্ধ। তাজউদ্দীন সাহেব, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং মনসুর আলী সাহেব একত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ১০ই এপ্রিল শনিবার রাতে “জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ” শুনলেন। ভাষণ শুনে মনসুর আলী সাহেব খুব আনন্দিত হলেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বারংবার অভিনন্দিত করলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের ওপর কিছুটা ক্ষুন্ন হলেন। (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ইচ্ছা করলে বিএসএফ-এর ওয়াকী টকীতে মেসেজ দিয়ে উক্ত ভাষণ প্রচার বন্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।)
’৭১ সালের সেই সঙ্কটকালে প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক ও নির্ভুল। ১০ই এপ্রিল শনিবার রাতে উক্ত ভাষণ প্রচারিত হয়ে যাবার সাথে সাথে প্রবাসে বসে চক্রান্তকারী সিআইএ’র এজেন্ট মোশতাক, তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী (’৬৪ সালে পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে চাকরিকালীন সিআইএ’র সাথে গোপন সম্পর্ক প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত) গংদের বিভেদ সৃষ্টি করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার তৎপরতায় ১১ই এপ্রিল রবিবার থেকে বিরতি পড়ে। ১০ই এপ্রিলের সরকার গঠন, ছাত্রনেতাদের “বিপ্লবী ওয়ার কাউন্সিল” (সরকারের পরিবর্তে) গঠনের উদ্যোগ পরিহারে তাদেরকে সম্মত করানো এবং ১৭ই এপ্রিল শনিবার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতে পঠিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক “স্বাধীনতার সনদ” রচনায় ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের চীফ সেক্রেটারী আমার মামা রুহুল কুদ্দুস আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বার বার তার নাম ধরে বলে গেছেন, “বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম একজন ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্যার সম্পর্কে সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি বার বার বলে গেছেন, “তাজউদ্দীন সাহেব না থাকলে মোশতাকের চক্রান্ত জয়যুক্ত হতে পারতো এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য কিছু হয়তো হতো। ক্ষমতালোভী মোশতাকের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফিরে নাও পাওয়া যেতো।” খুনী মোশতাকের সুগভীর চক্রান্ত প্রতিহত করতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পাশে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। তাকে ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দন আহমদকে প্রবাসী সরকারের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সকল সচিব সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তারা সকলে মিলে ১৬ই ডিসেম্বর মনজিলে মকসুদে পৌঁছে দেন।
আল্লাহর রহমতে আজ জাতির জনকের কণ্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকার বাংলাদেশের মাটিতে পুনরায় ফিরে এসেছে। ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব-গাঁথা ও মান-মর্যাদা আবার ফিরে এসেছে। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা সদর্পে ও সগৌরবে আবার ’৭১-এর আমাদের রণধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”। মন-প্রাণ উজাড় করে উচ্চারণ করতে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।”
’৭১-এর বীরের জাতির মুকুট বাঙালির শিরে আবার পরিয়ে দিয়েছেন মহান জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলার ঘরে ঘরে আজ শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনার নাম। বীর বাঙালীর নাম।
বিশ্বের কোটি কোটি বঙ্গজননী, বিশ্বের যিনি যেথায় আছেন, বাঙালির পুণ্যময় ১৭ই এপ্রিলের পুণ্য প্রভাতে আপনার কোলের শিশুর কপালে আজ পরিয়ে দিন জয়টিকা। বিশ্বের ত্রিশ কোটি বাঙালি যে, যেখানে আছেন, বিশ্বের দিকে দিকে আজ উড়িয়ে দিন বাঙালির বিজয় পতাকা, আর তাতে স্বর্ণারে লিখে দিন, “বাঙালি বীরের জাতি, বাঙালি ৩০ লাখ শহীদের জাতি। বাঙালি শ্রেষ্ঠ জাতি, বাঙালি অমর জাতি। বাঙালি জাতির অমর প্রাণ, সূর্যের নামে নাম, শেখ মুজিবুর রহমান। আকাশে যতদিন সূর্য উদ্ভাসিত হবে এবং পৃথিবীর বুকে সূর্য কিরণ ছড়িয়ে পড়বে, ততদিন সূর্যের পাশে বীর বাঙালি জাতি উদ্ভাসিত হবে এবং সূর্যের ন্যায় পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি পুণ্য কিরণ ছড়িয়ে দেবে। সেই কিরণে উদ্ভাসিত হবে মানবজাতি। উদ্ভাসিত হবে পুণ্যালোকে, শুভকর্মে। বিশ্ব ভূবন জুড়ে বাঙালি জাতির জয়গান উঠবেঃ জয় হোক বাঙালির। জয়তুঃ বাঙালি।
মুসা সাদিক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
infomusabd@gmail.com