মু.আ.হুসাইন
২০১৫ সালের মার্চ মসের শেষের দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এমন এক ফরমানে স্বাক্ষর করেছিলেন যে তাতে দূষণ-বিমোচন জ্বালানী বিষয়ক কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হয় এবং এরই আলোকে পাথুরে কয়লার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ট্রাম্পের নতুন ফরমানের ফলে মার্কিন জ্বালানী শিল্পের ওপর পরিবেশ সংক্রান্ত নজরদারি ও এইসব শিল্পে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনের ওপর সীমাবদ্ধতা আর থাকছে না। এর অর্থ পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে থাকলেও তা ঠেকানোর বিষয়টি ট্রাম্প সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অ্যাজেন্ডাগুলোর মধ্যে আর থাকছে না। অন্য কথায় আবহাওয়া সংক্রান্ত প্যারিস-সমঝোতাকে উপেক্ষা করছে ট্রাম্প সরকার।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে পরিবেশ সংক্রান্ত সমঝোতায় বলা হয়েছিল পৃথিবীকে চলতি শতকের শেষ পর্যন্ত দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি গরম হতে দেয়া যাবে না। বিশ্বের ১৯৩ দেশের প্রতিনিধিরা এই সমঝোতায় সই করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বহু বছরের আলোচনায় অর্জিত প্যারিস-সমঝোতাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিল। পরিবেশবিদদেরকে এখন পৃথিবীকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য আগে ট্রাম্পের মাথাকেও শীতল করতে হবে। ট্রাম্পের মত গরম মাথার নেতাদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে, পরিবেশ বাঁচলেই মানুষ বাঁচবে।
গবেষণায় দেখা গেছে গত ১০০ বছরেও পৃথিবীর বাতাসের তাপ গড়পড়তায় প্রায় শূন্য দশমিক ১৮ ডিগ্রি থেকে প্রায় শূন্য দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বেড়েছে। গরম হওয়ার এই ধারা চলতে থাকলে আগামী ত্রিশ বছরে পৃথিবীর উষ্ণতা এক দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। যারা মনে করেন উষ্ণতা বাড়ার এই মাত্রা তো খুবই সামান্য তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারছেন না যে এই সামান্য তাপ বৃদ্ধিই আগামী বছরগুলোতে বিশ্বের পরিবেশের জন্য নানা সংকটকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
জাতিসংঘও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে পৃথিবীর পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের দূষণ কমানোর জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে চলতি শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবীর উষ্ণতা দুই দশমিক নয় থেকে তিন দশমিক চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়তে পারে যা হবে শিল্পায়নের যুগ থেকেও বেশি। আর এর ফলে দেখা দেবে অজস্র বিপর্যয়।
পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের অন্যতম তিক্ত পরিণতি হল এই গ্রহের তাপ বেড়ে যাওয়া ও বরফ গলতে থাকা এবং এর ফলে মহাসাগর ও সমুদ্রগুলোর পানির স্তরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৮৭০ সন থেকে এ পর্যন্ত সাগরগুলোর পানির স্তরের উচ্চতা বেড়েছে বিশ সেন্টিমিটারেরও বেশি। এই ধারা আগামী বছরগুলোতেও চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এরই পরিণতিতে ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী অর্ধেক মানুষের বাসস্থানই পানির নীচে চলে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তন কেবল প্রকৃতিতেই সীমিত থাকবে না। খরা, পানি ও বাতাসের নানা সংকট জোরদার হওয়া, কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয়ের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা বাড়তে থাকা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতা বা পরিমাণ কমে যাওয়া, চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং কৃষি-পণ্য ও গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী কমে যাওয়াও হবে আবহাওয়া পরিবর্তনের আরও কিছু মারাত্মক কুফল। আর কৃষি পণ্যের পরিমাণ কমে যাওয়ার অর্থ হল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যের নিরাপত্তা কমে যাওয়া তথা দুর্ভিক্ষ এবং সামাজিক অশান্তি দেখা দেয়া।
পৃথিবী গরম হতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও নানা সংকট বাড়তে থাকবে।
গবেষণা সংস্থাগুলোর মতে বিশ্বের উষ্ণায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে গ্রিন হাউস গ্যাস। আর এই গ্যাস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল নানা ধরনের ফসিল জ্বালানী ও কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিশ্বের মানুষ পাথুরে কয়লা এবং তেল ও গ্যাস পুড়িয়ে প্রতি বছর চার হাজার কোটি টন দুষিত গ্যাস আর ধুয়া বাতাসে ছাড়ছে।
সম্প্রতি নরওয়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক একটি আন্দোলনের সদস্য গ্লেন পিটার্স বলেছেন, পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে বিশ্বে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ খুব দ্রুত বাড়ছে এবং প্রতি সেকেন্ডে ভূপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলে ঢুকছে গড়ে ২৯ লক্ষ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড।
বিশ্বে আবহাওয়া পরিবর্তনের চলমান ধারা বজায় থাকলে ২০৮০ সাল নাগাদ পৃথিবীর অর্ধেক গাছপালা ও এক তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রাণী বিলুপ্ত হতে পারে। আর এ বিষয়টি মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এক বড় হুমকি। আর এ ধরনের হুমকির বিষয়ে গভীর উদ্বেগের কারণেই ২০১৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্যারিস সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর জন্য একটি সমঝোতা হয়েছিল। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঠেকানোর লক্ষ্যে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা গড়পড়তা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কমানোর অঙ্গীকার করা হয়েছিল প্যারিস-ঘোষণায়। এই ঘোষণা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল মার্কিন সরকারও। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এরই আলোকে দূষণ-বিমোচন জ্বালানী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। তার ওই কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল মার্কিন সরকার ২০০৫ সালের তুলনায় গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদন ৩২ শতাংশ কমাবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যেই দেশটি এই লক্ষ্য অর্জন করবে। ওবামা পাথুরে-কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা ও এ ধরনের নতুন কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও মিথেন গ্যাস ছড়ানো বন্ধ করতে হাইড্রোলিক-ব্রেক পদ্ধতিতে গ্যাস ও তেল উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওবামা। কিন্তু গত ২৮ মার্চে ট্রাম্পের নতুন নির্দেশের ফলে পরিবেশ-বান্ধব ওইসব পদক্ষেপ বাতিল হয়ে গেল এবং এর মাধ্যমে প্যারিস-সমঝোতা অগ্রাহ্য করল মার্কিন সরকার।
অন্য কথায় মার্কিন সরকার আবারও সেই অবস্থাতেই ফিরে গেল যে অবস্থায় দেশটি বিশ্বে দূষণ সৃষ্টিকারী গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপাদনে ছিল বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে। বিশ্বে দূষণ সৃষ্টিকারী গ্যাসগুলোর ১৭ শতাংশই উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য আজকাল এক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে চীন।
ট্রাম্পের ওই পদক্ষেপ বিশ্বের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করবে ও বিশ্বের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনবে বলে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন।
মু.আ.হুসাইন, পার্সটুডে