আনজুমান আরা শিল্পী
২৩ মে অনেকটা নিরবে চলে গেল উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের ২৩ মে ৯০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সে রকম লক্ষনীয় আয়োজন চোখে পড়েনি। অথচ এই মহিয়সী নারীর বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণে ভূমিকা অনন্য।
নূরজাহান বেগম বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং সাহিত্যিক। তার সাথে দেখা ও কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল বেশ কয়েকবার। পুরান ঢাকার শরৎ গুপ্ত রোডের ৩৮ নম্বর বাড়িতে ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রথমবার তার বাড়িতে যাই সাংবাদিক দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকার সহ সম্পাদক দিলরুবা খান, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্টার রাবেয়া বেবীর সঙ্গে। সেদিন তিনি সাদরে আমাদের তার পাশে বসালেন। করলেন অতীত স্মৃতি রোমান্থন। অসুস্থ শুনে দ্বিতীয়বার গত ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার আবারও দিলরুবা আপা আর মানবকণ্ঠের রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন ছুটে যাই চিরচেনা তার সেই বাড়িতে।
তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘মেয়েদের অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। সেই বাধা আমরা ভেঙেছি। ১৯৪৭ থেকে ২০১৫। এখনো বেগম আপনাদের হাতে আছে। আমি না থাকলেও আশা করি বেগম বেঁচে থাকবে। একটি পত্রিকা হিসেবে সে যুগে বেগম যা করেছে আমি মনে করি না আর কোনো পত্রিকা সেভাবে তা করতে পেরেছিল’। বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার যদি হন বেগম রোকেয়া তা জীবনে প্রয়োগের রূপকার তবে ‘সাপ্তাহিক সচিত্র বেগম’ বা নূরজাহান বেগম।
সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকাকে ৬৬ বছরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এ পত্রিকা বাঙালি নারীদের সৃজনশীল লেখালেখি ও নারীশিার সূচনা করেছিল। রাস্তা থেকেই দেখা যায় কালের দর্পণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন’। দোতলা এ বাড়িতে নূরজাহান বেগমের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হলে মোট ১৪টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়েছিল। লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে বাড়ির ভেতরের প্রশস্ত চারকোনা উঠান।
১৯৫০ সালে কলকাতা ছেড়ে সাংবাদিক ও ‘সওগাত’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ঢাকার এ বাড়িতে নিবাস গড়েন। সেই থেকে ৬৫ বছরের রোদ-বৃষ্টি সামলে শরৎ গুপ্ত রোডের ৩৮ নম্বর বাড়িটি আজও অমলিন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিপাটি প্রশান্তির ছায়া এ বাড়ির অলিন্দে, অন্দরে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে দেয়ালজুড়ে ইতস্তত সাজিয়ে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, সম্মাননা স্মারক, পেইন্টিংস।
নূরজাহান বেগম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দোতলায়ই থাকতেন। যে সময় আমরা গিয়েছিলাম সে সময় ছোট একটি খাটে পাশ ফিরে কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন নূরজাহান বেগম। পেছনের দেয়ালে যে ছবিটি; ওটা নূরজাহান বেগমের বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের।
আগের মতো কানেও শুনেন না। চিনচিন করে পেটে ব্যথা হয়। আমাদের দেখেই উঠে বসে জানালেন এসব কথা। জানালেন ডাক্তার দেখিয়েছেন। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলেছেন। কানে আগের মতো শুনতে না পেরে মাঝে মাঝে কেঁদে উঠলেন তিনি। জানালেন, ‘শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আমি এখন জীবনের শেষ অধ্যায়ে অবস্থান করছি’।
তিনি বলেন, বেগম বাংলার প্রথম সচিত্র মহিলা সাপ্তাহিক। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়। সাহিত্যেেত্র মেয়েদের এগিয়ে আনার লক্ষে সাহিত্যচর্চার পৃথক ক্ষেত্র হিসেবে বেগম বের হয়।
আজকাল তো পত্রিকার পাতা খোলাই যায় না। তাতে শুধু ফতোয়া আর নারী নির্যাতনের খবর। নারী নির্যাতকদের কঠোর শাস্তি না দিলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। বেগম-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তবে চার মাস পর থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদনা শুরু করেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সুযোগ্য মেয়ে নূরজাহান বেগম। বেগম-এর প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল বেগম রোকেয়ার ছবি।
এখনও প্রিন্টার্স লাইনের দিকে চোখ দিলে দেখা যাবে: ‘সম্পাদিকা ও প্রকাশিকা: নূরজাহান বেগম, ৬৬ লয়াল ষ্ট্রীট, ঢাকা-১১০০। সওগাত প্রেস ঢাকা হইতে নূরজাহান বেগম কর্তৃক মুদ্রিত’। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটি এখন মাসিক পত্রিকা হিসেবে বের হচ্ছে। এই পত্রিকায় কার লেখা যাবে, কার ছবি যাবে, কোন কোন বিষয় থাকবে তার সবই করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নূরজাহান বেগম। তবে বয়সের কারণে পত্রিকাটির সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার বড় মেয়ে ফোরা নাসরীন খান।
কথা বলতে বলতেই নূরজাহান বেগম ডাকলেন তার দেখভালকারী কিশোরী শরিফাকে। তাকে তিনি বেগম পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি আনতে বললেন। মৃদু কণ্ঠে জানালেন, সরকার, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর কোথাও এ সংখ্যাটি সংরণ করেনি। নূরজাহান বেগমের কাছে থাকা একমাত্র কপিটি উইপোকা কেটে প্রায় কুটিকুটি করে ফেলেছে।
নূরজাহান বেগমের বিছানার কাছেই ল্যান্ডফোন। ফোনেই নানা খবর পান। বেগম পত্রিকার অফিস থেকে লোকজন এসে নিয়মিত সব বুঝে নেন। বাকি সময়টা শুয়ে-বসেই কাটাতে হয়। সংসার ও নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দুই মেয়ে ফোরা নাসরীন খান ও রিনা ইয়াসমিন আহমেদ সব সময় আসতে পারেন না মায়ের কাছে। তাই খানিকটা একাকিত্বেও ভুগছেন তিনি।
নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে। তার বাবা ১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে মাসিক সওগাত পত্রিকা বের করেন। নূরজাহান বেগম ও তার মা ফাতেমা খাতুনকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। মায়ের বোরকা খুলে জ্বালিয়ে দেন বাবা। নূরজাহান বেগম বিএ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। বাবার পরে নূরজাহান বেগমের পাশে দাঁড়ান তার স্বামী কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান। তিনি দাদাভাই নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালে দাদাভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।
নূরজাহান বেগম বলেন, ‘বেগম’ প্রকাশে আমার স্বামী সব সময় সহযোগিতা করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি সুফিয়া কামালসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছেন নূরজাহান বেগম। নূরজাহান বেগম আপে করে বলেন, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপরে কাছে বাবার সব পদক তুলে দেওয়ার পরও জাদুঘর কর্তৃপ বাবার নামে একটি কর্ণার খোলেনি। বাবার সঙ্গীদের সবার নামে একটি করে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। শুধু বাবার নামে করা হয়নি। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, গ্রাম থেকে মা আর আমি মামার সঙ্গে কলকাতা আসি। আমাকে দেখে বাবা মামাকে বললেন, আমার মেয়েকে কী সাজিয়ে এনেছ তোমরা! তেল লেপ্টা আমার চুলগুলো দু’পাশে টানটান করে বাঁধা ছিল। বাবা অপছন্দ করতেন বলে কান-নাক থেকে গহনাও খুলতে হয়েছিল।
একদিন বাবাকে ফোন দিয়ে বেগম রোকেয়া বললেন, আমার স্কুলে আপনার মেয়েকে দেন। বাবা বললেন, আমার মেয়ে তো খুব ছোট। উত্তরে রোকেয়া বলেন, আমার স্কুলে শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য সব আছে মহিলা দাই, কেয়ারটেকার। স্কুলে গিয়ে দেখলাম, একটা ঘরে এত শিশু। এত বন্ধু পাব আমি, আমার মনটা সেদিন আনন্দে ভরে গেছে।
বেগম রোকেয়া যেমন নারীদের লেখাপড়ার দিকে জোর দিয়েছেন তেমনি তাদের সাহিত্যচর্চা আর লেখালেখির স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন নূরজাহান বেগম। অতীতের চোখে তাকিয়ে তার গর্বিত উচ্চরণ, ‘বড় আনন্দ লাগে যখন ভাবি এ অঞ্চলে নারী জাগরণের জন্য কিছু একটা করে যেতে পারলাম। আমরা যখন আরম্ভ করি তখন কিন্তু এখনকার মতো এত সহজ ছিল না সবকিছু’।
ছয় কিংবা সাত বছর বয়স থেকেই সওগাত পত্রিকার নানা কাজের সঙ্গী হয়েছেন তিনি। পড়াশোনার ফাঁকে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, ফাইলবন্দি টুকটাক কাজ করে দিতেন। সওগাত যখন প্রথম ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সে সময় বেশ সমালোচনা ওঠে চারপাশে।
স্মিত হেসে শৈশবে হারিয়ে গেলেন নূরজাহান। বলেন, একবার একজন পীরসাহেব আব্বাকে চিঠির মাধ্যমে জানালেন, পত্রিকাটি পড়ে ভালো লাগল কিন্তু ছবিটা না ছাপালে ভালো হয়। আব্বা উত্তরে লিখেছিলেন আপনি নামাজ পড়ার সময় বিদেশী সাহেবের ছবিযুক্ত কয়েন পকেটে রাখতে পারেন তাহলে পত্রিকায় ছবি ছাপানো কি দোষের?
বাবার এমন সাহসী কাজের জন্যই বোধহয় লড়ে যাওয়ার মতাটা সহজাত নূরজাহান বেগমের। পাশাপাশি ছিল মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উৎসাহ। সাংবাদিকতা সবচেয়ে সম্মানের পেশা ভাবনাটা তার মনে বুনে দিয়েছেন তিনিই।
সওগাত পত্রিকায় প্রথম যে নারীর লেখা ছাপা হয় তা ছিল বেগম রোকেয়ার। দ্বিতীয় পাতায় ছাপা লেখাটা ছিল মানকুমারী বসুর। তাতেও মেয়েদের সাহিত্যচর্চায় খুব একটা সম্পৃক্ত করা না গেলে কবি নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনসহ তরুণ সাহিত্যিকরা ঠিক করলেন, পত্রিকায় মেয়েদের ছবিসহ লেখা ছাপাবেন। ১৯২৯ সালে প্রথম সওগাত মহিলা সংখ্যা বের করা হয়। তাতে দেখা যায়, যেসব তরুণী লেখা দিয়েছেন, তারা কখনো আগে কোথাও লেখেননি।
১৯৩০ সালে নারীদের লেখা ও ছবি দিয়ে সওগাত প্রথম নারী সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে প্রথম কবি সুফিয়া কামালের ছবিসহ লেখা ছাপা হয়। এভাবে সওগাতে বছরে একবার নারীদের লেখা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হতো। সে ধারাবাহিকতা ছিল ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।
১৯৪৬ সালের কথা, রাজনৈতিক পটবদল ও সংকটের ফলস্বরূপ দাঙ্গায় আক্রান্ত কলকাতা। এর মধ্যেই নারী প্রগতির নানা রকম পরিকল্পনা করছেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। নূরজাহান বেগম বলেন, কীভাবে নারীদের এগিয়ে নেয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতেন বাবা। আমাদের বাড়ির কাছে পার্ক সার্কাসে থাকতেন কবি সুফিয়া কামাল। বাবা উনাকে ডেকে বললেন, নারীদের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রয়োজন।
সুফিয়া কামালকে সম্পাদক করে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক বেগমের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয়। উপমহাদেশে বাঙালি নারীদের প্রথম সচিত্র পত্রিকার জš§টা এভাবে। দেশ ভাগের কিছুদিন পর সুফিয়া কামাল ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে এলে বেগম সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তায় নূরজাহান বেগমের ওপর। সেদিন তিনি কি টের পেয়েছিলেন কত বড় একটা দায়িত্ব কাঁধে নিলেন কিংবা সৃজনশীল নারী লেখক তৈরির নতুন পথ নির্মাণে ব্রতী হলেন? ১৯৪৮ সালে প্রথম লেখিকাদের ছবিসহ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে সাপ্তাহিকীটি। সে সময় দাঙ্গার জন্য অনেক মুসলিম পরিবার ঢাকায় চলে আসে। নারী লেখকের সংকট ছিল। অনেক লেখা অনুবাদ করে মেয়েদের নামে ছাপা হয়েছে। শুধু নারীদের লেখা নিয়ে একটি সাপ্তাহিক বের করা সহজ ছিল না তখন। যদিও শিশুস্বাস্থ্য, কৌতুক, জেনে রাখো, ঘর সাজানোর মতো বিভাগ থাকত বেগমে। সেই ছয় দশক আগে ‘সুইট সিক্সটিন’ নামে তরুণীদের একটি বিভাগ ছিল বেগমে।
কবি সুফিয়া কামালের পাশাপাশি বেগম তখন লেখক হিসেবে পেয়েছে শামসুন নাহার মাহমুদ, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, সাঈদা খানম, লায়লা সামাদ, জাহানারা আরজুসহ অনেককে।
ঢাকায় আসার দু-তিন বছর খুব ধকল গেছে বেগম কর্মীদের। ছদ্মনামে লেখা প্রকাশ হতো। ১৯৫৪ সালে আমেরিকা থেকে সাংবাদিক আইডা আলসেথ আসেন বেগম পত্রিকার কার্যালয় পরিদর্শনে। ভাঙাচোরা অফিসটাকে কোনো রকম ঢেকেঢুকে অভ্যর্থনা জানানো হলো তাকে। তখন বেগম প্রকাশ হতো ক্রাউন সাইজে। পত্রিকা দেখে মুগ্ধ আইডা নূরজাহান বেগমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এত লেখা প্রত্যেকটা পাতায়, কেন তুমি ছবিতে যাচ্ছ না? পত্রিকায় ছবি কথা বলবে’।
উত্তরে নূরজাহান বেগম বলেছিলেন, এখানে তো লেখিকাদের সঙ্গে যোগাযোগটা কম। আইডা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মেয়েদের নিয়ে একটি কাব গঠনের। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম কাব। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে প্রেসিডেন্ট আর নূরজাহান বেগমকে সেক্রেটারি করে গঠিত হয় কাবটি। বেগম কাবের হাত ধরে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে ‘বেগম’। এত এত লেখিকা আসতেন যে জায়গা দিতে পারতেন না তারা। এ কাবের হয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে সে সময় এগিয়ে নিয়েছেন হুসনা বানু খানম, লায়লা আঞ্জুমান বানুরা।
নূরজাহান বেগমের জীবনে অন্যতম অধ্যায় হয়ে এসেছিলেন রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই)। শিশু সওগাতের সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। সওগাত প্রেসেই নূরজাহান বেগমের সঙ্গে তার পরিচয়। তখনকার দিনে ঝুড়িতে করে মালিরা ফুল সাজিয়ে নিয়ে বাড়ির দরজায় হাজির হতো। দাম দিয়ে কেনা যেত তা। সওগাত প্রেসে কোনো এক সন্ধ্যায় মালির কাছ থেকে রজনীগন্ধা কিনেছিলেন নূরজাহান বেগম। তা দেখে দাদাভাই বলেছিলেন, ‘ফুলগুলো খুব সুন্দর’।
বিবাহিত জীবন আর কর্মেেত্র রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের উদার সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। মেয়েরা যদি সত্যের জন্য লড়াই করেন তাহলে সেখানে জয় আসবেই।
নূরজাহান বেগম এখনো বেগম পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান নারীদের জন্য। যেভাবে আছে যতটুকু আছে নতুন লেখিকা সৃষ্টির জন্য বেগম যেন বেঁচে থাকে এটাই তার একমাত্র ইচ্ছা।
তিনি বলেন, আমাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ও দেশকে সমৃদ্ধ করতে নারী-পুরুষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশে শিার হার না বাড়লে পুরুষ ও নারীকে পৃথক সারিতে থাকতে হবে। গ্রামে স্কুলপড়ুয়া শিার্থীদের ঝরেপড়া রোধ করতে হবে। শিার বিকল্প নেই। সবাইকে নিজ ধর্ম ও সমাজের মূল্যবোধ মেনে চলতে হবে। মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে।
‘নারীরা জাগো’ এখনো এ আদর্শকে সামনে রেখে বের হয় বেগম। পাটুয়াটুলীর বেগম কার্যালয়ের নূরজাহান বেগমের কটা এখন তালাবদ্ধ। সম্পাদনার প্রধান কাজটি করেন ফোরা নাসরীন খান।
লোহার গেট পেরিয়ে ৩৮ নম্বর বাড়িটি পেছনে রেখে আসতে আসতে কানে বাজতে থাকে নূরজাহান বেগমের কথা ‘আজ তোমরা কেউ ঘর থেকে বের হতে পারতে না যদি সে সময় আমরা আন্দোলন না করতাম। পত্রিকার মাধ্যমে লেখায়, ছবিতে এগিয়ে না যেতাম তোমরা অবরুদ্ধ থাকতে। আমরা অবরোধটা ভেঙেছি। এখন তোমাদের কাজ হলো এগিয়ে যাওয়া। যে যে মাধ্যমে চলতে পারো সেভাবে এগিয়ে যাও’।
আনজুমান আরা শিল্পী : সাংবাদিক