দলীয় প্রতীক-ই হউক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন

আখতার-উজ-জামান ||  ভোটের অধিকার নিয়ে দেশ উন্নয়নের দাবি-দাওয়া সাধারণ জনগণের ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার। আর এই অধিকারকে কোন সহিংসতার রূপে দেখতে চায় না সাধারণ মানুষ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়নের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, থানা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন। কিন্তু সেই ভোটের মৌলিক অধিকারকে যদি ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা গণতন্ত্রের মাঠে রাজনৈতিক সহিংসতার রূপ নেয়, তাহলে কিভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনী আচরণীতে অবশ্যই গণতান্ত্রিক সংবিধান জড়িত। আর সেই গণতান্ত্রিক রূপ রেখায় জনগণের প্রত্যাশিত কাউকে না কাউকে ভোটের অধিকার বাস্তবায়ন করে প্রতিটি অঞ্চল ভেদে একজন না একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিতে হবে।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি দেশের ৪৮২টি উপজেলা পরিষদে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ সময় কেটেছে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্যের ভেতর দিয়ে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খুবই সীমিত থাকার ফলে কার্যক্রমের পরিধি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি।

চেয়ারম্যানদের সামান্য ক্ষমতা থাকলেও ভাইস চেয়ারম্যানদের সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ কিংবা দায়িত্ব নেই বললেই চলে। এতে সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ছাড়া পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও মূলত তারাই আর্থিকসহ প্রশাসনিক অধিকাংশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তাছাড়া তাদের বেতন-ভাতা দেয়ার ক্ষমতাও উপজেলা পরিষদ রাখে না। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যানরা মূলত তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

যদিও শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ‘উপজেলা পরিষদ আইন’ সংশোধন করার দাবী জানিয়েছে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন।

উপজেলা পর্যায়ে সরকারের ১৭টি বিভাগের ৭০টি কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এসব কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর উপদেষ্টা সংসদ সদস্যরা। কাজগুলো ইউএনও এবং এমপি মিলে করে থাকেন। কাজগুলো উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে আসেও না এবং চেয়ারম্যানদের প্রয়োজনও পড়ে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইন সংশোধন করে উপজেলা পরিষদকে আরো কার্যকর করতে হবে।

জনগণের কাছের সরকার ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নজির নেই। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো স্থানীয় তথা জাতীয় সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই এবার যেই নির্বাচিত হউক না কেন তাদের অবশ্যই সুদৃষ্টি রাখতে হবে দেশের উন্নয়মূলক কার্যক্রমের দিকে।

যেমন- উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়ন, প্রশাসন, নির্বাচন, অর্থ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বনায়ন, পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর গঠন ও নগরায়ণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, চিকিৎসা, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি সমবায়, হাটবাজর, উন্নয়ন, গণপাঠাগার, বিচার ব্যবস্থা, যোগাযোগ, বিনোদন, পরিবহন, আইন-শৃঙ্খলা, বাজেট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুৎ, শিল্প, কুটির শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, রাস্তাঘাট ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা, বিতর্ক, সমাধানমূলক উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিধি, প্রবিধি প্রণয়ন, বাজেট অনুমোদন, পরিকল্পনা প্রণয়ন করার জন্য প্রতিটি উপজেলায় কিংবা পৌরসভায় সম্ভাব্য মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের কর্মপরিধি খুবই গুরুতের সাথে এই ভোটের মাধ্যমে তাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়িত করতে হবে।

যদিও বর্তমান সরকারের চিন্তা চেতনা অনেকটা সুদূর প্রসারী। তাই সরকারকে আরও শক্তিশালী রূপ রেখায় পৌঁছে দিতে এবারের প্রতীকি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এর মধ্য দিয়ে সকল প্রজন্মের দৃষ্টিতে এই নির্বাচন সত্যিকারের একটি ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার পর।

ফিরে যাই পাঁচটি স্তরে সাজানো বর্তমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও সিটি কর্পোরেশন। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হলেও এবারের পৌরসভা নির্বাচন হবে অধ্যাদেশের আওতায়,  প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক নিয়ে পৌরসভা নির্বাচন।

৪ হাজার ৫৫৩টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা-৪৮৮টি, পৌরসভা-৩২৩টি, জেলা পরিষদ-৬৪টি এবং সিটি কর্পোরেশন-১১টি। নির্বাচিত স্থানীয় সরকারগুলোর মেয়াদকালও আমাদের জাতীয় সংসদের আদলে ৫ বছরই হয়ে থাকে। যদিও আসন্ন নির্বাচনে ২৩৪টি পৌরসভার ১৫৬টিতেই মেয়র পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তারপরও সারাদেশে এবারই প্রথম দুই শক্তিশালী দল তাদের দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোটের যুদ্ধে নেমেছেন। অন্য ৭১টি পৌরসভায় এগিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা।

গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনায় বর্তমান রাষ্ট্র নায়কদের এটা একটি সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে। তাই সহিংসতা কিংবা সংঘাতের দিকে না গিয়ে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ একটি পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হউক এটাই সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন সংঘাত কিংবা সংহিসতার পথ বিবেচনায় না রেখে সাধারণ মানুষের যাতে ভোটের মাধ্যমে তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেটার দ্বার প্রান্তে পৌছে দিতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

কাজেই সহিংসতা আর বিরোধিতা না করে সকল রাজনৈতিক দলকে ব্যতিক্রমী নির্বাচন আর ৪৪ বছরের সার্বভৌম ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শক্তিশালী দলগুলো তাদের দলীয় প্রতীক নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে ২৩৪ টি পৌর-নির্বাচন। আর গণতান্ত্রিক দেশে ভোটের মৌলিক অধিকার নিয়েই বেছে নিতে হবে কাউকে না কাউকে তার মূল্যবান ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাই দলমত নির্বিশেষে সকল দলকে সহিংসতার দিকে ঠেলে না দিয়ে কিভাবে সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নেয়াই হবে গণতন্ত্রের সুগম পথ।

শুধুমাত্র কেন্দ্রমুখী গণতন্ত্রের চর্চা হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়না। সব তর্ক-বিতর্কে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গ খুব কমই আলোচিত হয়েছে। পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা থেকে মনে হবে এসব প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট ক্ষমতাবান, শুধু প্রয়োচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। তবে যে বিষয়ে কোন ধরনের তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে না তা হল কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা, সহিংসতা হরহামেশাই হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে অবশ্যই প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। যেন বিরোধী দল কিংবা সরকারী দলের প্রার্থীরা বলতে না পারে প্রশাসন একপক্ষভাবে কাজ করছে।

জনগণের আশা-আঙ্খাকে বাস্তবায়ন করতে হলে পৌরসভা নির্বাচনকে অবশ্যই সংঘাতের দিকে না গিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মনে করেন ভোটাররা।

দুই শক্তিশালী দলের পাল্টাপাল্টি নির্বাচনী প্রচারনায় শেষ প্রান্তে এসে উভয়ই মনে করেন, দলীয় ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি জোরালো যুক্তি হল, এর ফলে রাজনীতিতে দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্ষমতাসীন দল তার নির্বাচনী কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকারি নীতিমালা অনুসরণ এবং নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নে অধিক মাত্রায় আগ্রহী হবেন। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ভাবনা তৃণমূলে সম্প্রসারিত হতে সহায়তা করবে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকার তথা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে তারা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে না, এখন দলের অযাচিত হস্তক্ষেপের ভারও বইতে হবে। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার ন্যুনতম সম্ভাবনা থাকবে না বলেও বিরোধী প্রার্থীরা মনে করেন। তাদের মতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ায় প্রশাসন নির্বাচনে একধরণের নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে থাকে। দলীয় ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে প্রশাসনের এরূপ নিরপেক্ষতাও থাকবে না।

তাই গণতন্ত্রের শক্তিশালী রূপায়ন ঘটাতে গেলে দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিকল্প নাই বলে মনে করতে পারি। একদম খোলামেলা ভাবে আমরা আমাদের স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রভাব লক্ষ্য করে থাকি। সরকারী দল কিংবা বিরোধী দলের প্রভাবকে নির্বাচনী মাঠে না দেখিয়ে সকলের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় যার যার পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে তার মূল্যবোধ যাচাইয়ের সুযোগ দেয়াইটাই হবে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা।

বহুল প্রত্যাশিত জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতেই এবারের স্থানীয় নির্বাচন হবে দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীকে। তাই সহিংসতার হাত পরিহার করে দুই শক্তিশালী দলসহ ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই অংশ গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নয়ন করার জন্য ভোটের এই মৌলিক অধিকার রক্ষাই হবে গণতন্ত্রের সুগম পথ।

azamanrahat@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts