গণপরিবহনে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন

রোকেয়া লিটা  []

আমরা নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলি, কিন্তু তারপরও কিছু কিছু জায়গায় পুরুষের তুলনায় বেশি সুবিধা চাই। বাসে সংরক্ষিত নারী আসন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ইস্যু।

কেন চাই? এ নিয়ে পুরুষের বাঁকা বাঁকা কথা প্রায়ই শুনতে হয়। বিশেষত, এবছরের মার্চ মাসে ”সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭” এর খসড়ায় গণপরিবহনে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনে পুরুষ বসলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হলে, এই বিতর্ক আরও জোরদার হয়ে ওঠে। আমার প্রায়ই মনে হয় বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা দরকার। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার এই সংকীর্ণতা দূর হওয়া খুব জরুরি।

আমি প্রায় এক বছর ধরে সিঙ্গাপুরে বাস করছি। এখানকার বাস বা ট্রেনে কখনও নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন রাখতে দেখিনি। আমি বিশ্বের আরও কয়েকটি উন্নত দেশের গণপরিবহনে চলাফেরা করেছি, সেসব দেশের গণপরিবহনেও কখনও সংরক্ষিত নারী আসন দেখিনি।

তবে, কিছু সংরক্ষিত আসন থাকে, শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ বা সাথে ছোট শিশু আছে এমন মায়েদের জন্য।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সুস্থ-সবল কোনো মানুষের জন্য আসন সংরক্ষণ করে রাখা আর তাকে দয়া করা একই কথা। যার ন্যূনতম আত্মসম্মান আছে, সে এই দয়া গ্রহণ করতে চাইবে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা সংরক্ষিত নারী আসন ছেড়ে দেবার জন্য বাসে চিৎকার-চেঁচামেচি করি, পুরুষ যাত্রীদের সাথে ঝগড়া করি। কেন?

কারণ,বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এতই নিম্নমানের আর এতটাই অপ্রতুল যে সংরক্ষিত নারী আসন থাকার পরও ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা একজন নারীর জন্য ভীষণ ভীতিকর একটা ব্যাপার।

একে তো পর্যাপ্ত বাস নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা বাস হয়ত এলো, তাতে সবাই দৌড়-ঝাপ দিয়ে উঠবে, বাসের ভেতরে গাদাগাদি করে দাঁড়াবে, কেউ আবার বাসের দরজার হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাবে।

হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন যে নারীরা তো সমঅধিকার চায়, তাহলে তারাও ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠুক, গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকুক বাসের ভেতরে। এমন যুক্তি তুলে ধরার পূর্ণ অধিকার রয়েছে আপনার।

কিন্তু, ভিড়ের মধ্যে কোনো নারী বাসে উঠতে গেলেই হয়তো দেখা যাবে কেউ একজন কনুই দিয়ে ওই নারী যাত্রীটির স্পর্শকাতর কোনো এক স্থানে আঘাত করেছে। বাসের ভেতরে গাদাগাদি করে দাঁড়ালেই দেখা যাবে কেউ একজন ওই নারী যাত্রীটির শরীর স্পর্শ করে কোনো বিকৃত সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন কী বাসের ভেতরে কোনো আসনে বসে থাকার পরও নারীকে নানা ধরণের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

আমি বেশ কয়েকজন নারীর মুখে একই অভিজ্ঞতা শুনেছি। অনেক পুরুষই নাকি সিটে বসে থাকা কোনো নারীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজের পুরুষাঙ্গ ওই নারীর শরীরে ছোঁয়ানোর চেষ্টা করে।

আবার অনেক পুরুষকেই দেখা যায়, কোনো নারীর পাশে বসলে এমন ভাবে জায়গা দখল করে বসে যে, পাশে বসে থাকা নারীর সাথে তার শরীরের ঘষা লাগতে বাধ্য।

নারী মহলে এমন আরো অনেক হয়রানির কথা শুনতে পাওয়া যায়, যা ঘটাচ্ছে কিছু বিকৃত মানসিকতার পুরুষ আর তার সমর্থন দিচ্ছে আরও কিছু মাথামোটা বিবেক বর্জিত পুরুষ। এসব হয়রানির ক্ষেত্রে বেশিভাগ মেয়েই মুখ বুজে সব সহ্য করে।

আজকাল কিছু কিছু মেয়ে, এসব নির্যাতনের প্রতিবাদ করছে বটে। কিন্তু, যেহেতু গণপরিবহনে নারীর সংখ্যা কম, হয়তো দেখা গেল ৫০ সিটের একটি বাসে নারী যাত্রী রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ৯ জন, কখনও কখনও আরও কম।

তাই, কোনো মেয়ে এসব হয়রানির প্রতিবাদ করলে, তার চারপাশের মাথামোটা পুরুষরাও ওই নিপীড়ক পুরুষের পক্ষ নিয়ে মেয়েটির সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। এভাবেই প্রতিদিনের নির্যাতন সহ্য করে একেকজন নারী ঢাকা শহরে চলাচল করছে।

আমি যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলছি, তার চিত্র কিন্তু এমন নয়। এখানে বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, একটু পরপরই বাস আসছে।

এত ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতেও হয় না। আর নারীর প্রতি কোনো শারীরিক নিপীড়নের তো প্রশ্নই ওঠে না। বরং মেয়েদেরকেই এখানে অনেক ক্ষমতাবান মনে হয়। পাশে ফাঁকা সিট, তারপরও বসছে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কারন, দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ তো আর তার গায়ে নোংরা স্পর্শ করছে না।

এসব দেশের গণপরিবহনে প্রচুর নারী যাত্রী চলাফেরা করে। আইনের প্রয়োগও বেশ কড়াকড়ি। ফলে কোনো পুরুষ বাসে কোনো নারীকে বিরক্ত করবে, সেটা কল্পনাই করা যায় না।

কী জনাব, আপনার উত্তর পেয়েছেন তো? কেন নারীর জন্য গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ করতে হবে, তা তো এখন পরিষ্কার। আপনারা পুরুষরাই গণপরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করছেন।

এই বাজে পরিবহন ব্যবস্থার কারণেই বাংলাদেশের অনেক মেয়ে ঘরে বসে আছে। একটা সময় আমার বেতনের প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করতে হতো সিএনজি চালিত অটোরিকশা পেছনে। কারণ, বাসে চলাফেরা করতে পারতাম না।

ঢাকার চাকরিজীবী মেয়েদের বেশিভাগের অবস্থাই এই রকম। হয়রানির কারণে তারা বাসে উঠতে চায় না। ফলে, বাসে নারী যাত্রী কম। আর নারী যাত্রী কম থাকার সুযোগটাই নেয় লম্পট পুরুষরা।

শরীরে নোংরা স্পর্শ থেকে গণ ধর্ষণ,গণপরিবহনে প্রায় সব ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা।

মোদ্দা কথা হলো, আমাদের দেশের গণপরিবহণে নারীরা হলো সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের জন্য সাংবিধানিকভাবেই চাকরি কোটা, শিক্ষা কোটাসহ নানা ধরণের সুবিধা দেয়া হয়েছে। পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে সামনে তুলে আনার জন্যই এসব কোটা দেয়া হয়ে থাকে।

গণপরিবহনে নারী কম এবং নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাই তাদের চলাফেরাকে মসৃণ করার জন্যই আসন সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু তাই বলে,সংরক্ষিত আসন এত কম কেন?

বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকে মাত্র ছয় থেকে নয়টি। কোনো কোনো বাসে নাকি ১৩ টিও থাকে। তবে, বেশিভাগ ক্ষেত্রেই এই সংরক্ষিত আসনগুলো থাকে ইঞ্জিনের পাশে। এটা ভীষণ অবমাননাকর।

সংরক্ষিত আসন দেয়ার নামে নারীকে এভাবে ইঞ্জিনের তাপে কয়লা বানানোর ষড়যন্ত্র প্রহসনমূলক। উন্নতমানের বাসগুলোতে ইঞ্জিনের পাশে নারী আসন কেন, কোনো আসনই রাখা হয় না।

আমদের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে চলছে সেই পুরনো আমলের লক্কড়-ঝক্কর বাস। ইঞ্জিনের পাশে কাউকে বসতে দেয়া রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর। সেখানে নারী আসন কেন?

আমাদের দেশ ভালো মানের পর্যাপ্ত বাস সংকুলান করতে পারছে না, আর সেজন্যই আজ বাংলাদেশের নারীরা সংরক্ষিত আসন নামক একটি দয়া গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। দয়া যখন গ্রহণ করতেই হবে, তবে এত অল্প কেন?

আমরা চাই, বাসে পুরুষের সমান সংখ্যক নারীও চলাফেরা করুন। তাই, বাসের অর্ধেক সিট নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হোক। নারী না উঠলে এসব সিটে পুরুষ বসবে, কিন্তু কোনো নারী উঠলেই সিট ছেড়ে দিতে হবে।

এভাবেই গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের উৎসাহিত করা সম্ভব এবং নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব। যখন থেকে গণ পরিবহনে নারী-পুরুষ সমান হবে, নারী কোনো নির্যাতনের শিকার হবে না, তখন আর সংরক্ষিত আসনেরও দরকার হবে না।

বিবিসি

রোকেয়া লিটা : লেখক-সাংবাদিক, সিঙ্গাপুর

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts