মোতাহার হোসেন
দেশের অর্থনীতি,বাংলাদেশ ব্যাংকের রির্জাভ বৃদ্ধিসহ দেশের সামগ্রীক কর্মকান্ডে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি,ব্যাংক সমূহের যথাযথ ভূমিকা পালন করলে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা আসবে।
বাংলাদেশের শ্রমিক বিশ্বস্থ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল, প্রতিশ্রুতিশীল বলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজন নতুন নতুন শ্রম বাজার অনুসন্ধান, এবং কূটনৈতিক তৎপরতা, বিদেশে চাহিদা অনুযায়ী খাতভিত্তিক শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা,বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা করেই জনশক্তি রপ্তানী বা শ্রম শক্তি প্রেরণের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনায় নেয়া দরকার। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করলে বৈদেশিক রেমিটন্স প্রবাহ আরো বাড়বে নি:সন্দেহে।
দেশের এক কোটি মানুষ কর্মসংস্থানের আশায় প্রিয়জন,বন্ধু,সতীর্থ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি,আর সীমাহীন শ্রমে,ঘামে অর্জিত অর্থই দেশের অর্থনীতি,বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ সমৃদ্ধ করছেন। তাদের সেই টাকায় ভর করে আরো গতিশীল হয়ে উঠছে অর্থনীতির চাকা। জনশক্তি রপ্তানি খাত দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ৩১ বিলিয়ন ডলারে, যাতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানই বেশি।
২০০৮ সালের পর ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে গত বছর দেশের বাইরে গেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কর্মী। পুরনো শ্রমবাজার খোলার পাশাপাশি নতুন নতুন বাজারেও লোক পাঠানো শুরু হচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মী যাওয়ার হারও বাড়ছে। শুধু অদক্ষ কর্মীই নয়, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নার্স থেকে শুরু করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির হার বাড়ছে। দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে নির্মাণ করা হচ্ছে অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ উন্নত দেশেও কর্মী পাঠানো শুরু হচ্ছে। নতুন কয়েকটি শ্রমবাজারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কোটি প্রবাসীর পাঠানো টাকায় মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সদ্য প্রকাশিত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানিতে গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে সাত লাখ ৪৯ হাজার ২৪৯ জন শ্রমিক গেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে ওমানে, এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৮ জন। ওমানের পরই সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে গেছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৫০ জন। কাতারে গেছে এক লাখ ১৯ হাজার ৬৩৭ জন। এর পরই বাহরাইনে ৭১ হাজার ৭৪০ জন, সিঙ্গাপুরে ৫৪ হাজার ও কুয়েতে গেছে ৩৮ হাজার ৬৮২ জন বাংলাদেশি শ্রমিক।
এভাবে ১৬২টি দেশে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। শুধু সৌদি আরবেই বাংলাদেশি শ্রমিক আছে ২৬ লাখের বেশি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সে সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। গত ৮ বছরে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরবের শ্রমবাজার ফের চালু হয়েছে। এরপর সেখানে কর্মী যাওয়ার হারও বেড়েছে। নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০১৬ সালে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছে। কর্মসংস্থানের জন্য নারী কর্মীর বিদেশযাত্রা গত বছর আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
তবে বিদেশে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন কাজে প্রবাসে যাওয়া নারী কর্মীদের সহায়তায় সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করেছে।
শ্রমবাজারের হিসাবে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের পরেই মালয়েশিয়ার অবস্থান। সেখানে কর্মরত রয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শ্রমিক। চলতি মাসেই মালয়েশিয়ার বাজার খুলতে পারে, সেক্ষেত্রে আগামী পাঁচ বছরে সেখানে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক যেতে পারবে। আরব আমিরাতের শ্রমবাজার খোলার বিষয়েও উভয় পরে মধ্যে আলোচনা চলছে। আরব আমিরাতের সরকার বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কর্মী নেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে। আর লিবিয়া, ইরাক, কাতার, ওমানসহ পুরনো বিভিন্ন শ্রমবাজারে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার কিছুটা সংকোচিত হলেও জনশক্তি রপ্তানির নতুন বাজার হিসেবে যুক্ত হতে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। রুশ সরকার তৈরি পোশাক, নির্মাণ শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। কর্মী নিতে ইতিমধ্যে চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছে রাশিয়া। কয়েক বছরের তুলনায় বিদায় অর্থবছরে জনশক্তি রপ্তানির হার বেড়েছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। ইতিমধ্যে ৪০০ জনের ডিমান্ড লেটার পাওয়া গেছে। তৈরি পোশাক, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী যাবে। অস্ট্রেলিয়া সরকারও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে আগ্রহী। অল্প সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য বড় শ্রমবাজারের অংশ হতে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড, ম্যাকাও, জাপান, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, সুইডেন, অ্যাঙ্গোলা, গ্রিস, জর্দান, ইতালি, সাইপ্রাস, সুদান, লাইবেরিয়া, তানজানিয়া, আজারবাইজান, তাইওয়ান, স্পেন, পোল্যান্ডসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমবাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
গত বছর প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৫ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় দেশের অর্থনীতিতে তার অবদানও বেড়েছে। আগের ছয় লাখ কোটির মধ্যে রেমিট্যান্সের অবদান ছিল ৬ শতাংশ। আর এখন ১৭ লাখ কোটির জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ৭ শতাংশ। মোট আমদানি ব্যয়ের ৩৯ শতাংশ মেটানো হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। ২০১৫ সালে বিদেশে গেছে পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন কর্মী।
বাংলাদেশ থেকে সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো হয়। সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত ও ওমানেই ৫০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী আছে। তবে এর মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি অদক্ষ শ্রমিক। দেশগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেখানে চিকিৎসক ও নার্স পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে রেমিট্যান্স বাড়াতে তাই অদক্ষ কর্মীর পাশাপাশি দক্ষ কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ প্রয়োজন।
‘বিদেশের প্রচলিত শ্রমবাজারগুলো ঘিরেই মূলত বৈদেশিক কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর মধ্যে কোনো দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে কর্মী নেওয়া বন্ধ বা স্থগিত রাখলে চাপ পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। বাজার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ ১০টি নতুন দেশে শ্রমবাজার সম্পর্কে স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে। পুরনো অনেক শ্রমবাজারে আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে সারা দেশে প্রশিক্ষণ সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে; যেখান থেকে একটি বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে পারবে শ্রমিকরা। এতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের হার বাড়বে।
দু:খজনক হলেও সত্য, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও তাদের কল্যাণে তেমন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ৪৫ বছর পর প্রবাসীদের কল্যাণে ‘প্রবাসীকল্যাণ বোর্ড’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রবাসী কর্মীদের জন্য প্রবাস বীমার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ডায়াগনসিস সেন্টার, সন্তানদের পড়ালেখার সুবিধার্থে দেশে আবাসিক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান কোটার সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আবাসন ব্যবস্থার বিষয়টি ভাবনায় আনা দরকার।
প্রত্যাশা থাকবে, প্রশিক্ষিত শ্রম শক্তি তৈরীর লক্ষে ব্যাপকহারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশগামী কর্মীদের বিমান বন্দরে হয়রানী,ভোগান্তি,দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা হবে। বিদেশগামীদের সাথে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লা রংপুর ও যশোর থেকে বিদেশগামী কর্মীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার কার্যক্রম জোরদার করা হবে। পাশাপাশি এ ছাড়া অসুস্থ, বয়স্ক, বৃদ্ধ মৃত কর্মী ও তাদের পরিবারের সেবা প্রদানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হবে। এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও নের্তৃত্বে বাস্তবায়ন হলে এই খাতে গতি ফিরে আসবে। বাড়বে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ।
মোতাহার হোসেন : সাংবাদিক, কলামিষ্ট।
motaherbd123@gmail.com