শাহ মতিন টিপু
চলে গেলেন হরিধানের আবিষ্কারক হরিপদ কাপালি। অথচ এমন একজন গুণী আবিষ্কারকের নাম আজকের প্রজন্ম শুনেছে বলেও মনে হয়না। হরিপদ কাপালির মৃত্যুর পর তার আবিষ্কারগাঁথা শুনে অনেকেই চমকিত হয়েছে। কারণ অনেকেই এই প্রথম শুনেছেন এমন একজন নিরক্ষর কৃষি বিজ্ঞাণীর কথা। অথচ এর আগে তার খবর এমন করে মানুষের কাছে পৌঁছলে হয়তোবা মৃত্যুর আগে একটু ভাল চিকিৎসার ব্যাবস্থা হতো।
জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রত্যন্ত গ্রাম সদর উপজেলার আসাননগর গ্রামে নিজের বাড়িতে বসবাস করতেন হরিপদ। হরিপদ গত চার-পাঁচ মাস ধরে মূত্রনালীর অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তার প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ত। তাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসক দেখানো হচ্ছিল।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নানা পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছিলেন হরিপদ। এমনকী হরিপদর ঘরে জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ঢাকা রোটারি কাবসহ বিভিন্ন সংস্থার ১৬টি পদক দেখা যায়। হরিপদর পুত্রবধূ সুষমা বিশ্বাস বলেন, “ঢাকায় নিয়ে তাকে অনেকবার সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।” অথচ এমন একজন ব্যাক্তির চিকিৎসার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি কেউ-ই।
লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, বাংলাদেশের সেরা আবিষ্কার হরিধান। সম্প্রতি শাহবাগে ‘সায়েন্স ফিকশন বইমেলা’ উদ্বোধনকালে তিনি এই মত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে হরিধানকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলে বর্ণনা করেন। হরিধানের আবিষ্কারকে দৃষ্টান্ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘বাংলাদেশে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কী জিজ্ঞেস করলে, আমি বলবো হরিধান। যশোরে এক কৃষক এ ধান উদ্বোধন করেছেন। ধান লাগানো খেতে কৃষক দেখলেন, একটা নির্দিষ্ট ধানের গোছায় অনেকগুলো ধান। সাধারণ মানুষের মতো তিনি না গিয়ে সেটা নিয়ে আসলেন, আবার নতুন করে রোপণ করলেন। সেই হরিধান এখন ওই অঞ্চলে ব্যাপক আকারে চাষ করা হচ্ছে।’
বিশেষ জাতের উচ্চ ফলনশীল ‘হরিধানে’র জনক হরিপদ কাপালি বুধবার দিনগত রাত ১টা ১০ মিনিটে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ৯৫ বছর বয়সে মারা গেলেন।
এই গুণী ব্যক্তির জন্ম ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামে। ১৯৯৬ সালে তিনি এই হরিধান আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে ওই ধানের নাম রাখা হয় ‘হরিধান’।
তার ধান আবিষ্কারের ঘটনাটিও চমকপ্রদ। ১৯৯৯ সালে নিজের ধানের জমিতে একটি ছড়া তার নজর কাড়ে। ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ ছড়াটি তিনি নজরদারিতে রাখেন। ধানের ছড়া বের হলে তিনি দেখতে পান ছড়াগুলো তুলনামূলকভাবে অন্য ধানের চেয়ে দীর্ঘ এবং প্রতিটি ছড়ায় ধানের সংখ্যাও বেশি। ধান পাকলে তিনি আলাদা করে বীজ ধান হিসেবে রেখে দিলেন। পরের মৌসুমে এগুলো আলাদা করে আবাদ করলেন এবং আশাতীত ফলন লাভ করেন। এভাবে তিনি ধানের আবাদ বাড়িয়ে চললেন। আর নিজের অজান্তেই উদ্ভাবন করলেন এক নতুন প্রজাতির ধান। তার উদ্ভাবন আসাননগর গ্রামের মানুষের ছিল ধারণার বাইরে।
২০ বছর আগে যখন ধানের উচ্চফলনের চিন্তাও কৃষকের মাথায় আসতো না। চিরাচরিত নিয়মেই ফলন নিয়ে কৃষকদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো কৃষকদের, সে সময়েই ধানের ভাল জাত বেশি উদ্ভাবন নিয়ে ভেবেছিলেন হরিপদ কাপালী। নতুন জাত উদ্ভাবন করে তিনি কৃষি বিজ্ঞানীদের চমকে দেন। মিডিয়ার কাছে হরিপদ কাপালী দেশের ৫ম “নিরর উদ্ভাবক” হিসাবে স্থান পেয়েছেন।
আগেই বলেছি, এই উফশি জাতের ধান হরি উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে চমৎকার তথ্য। একজন প্রান্তিক কৃষকের হাতের আঁচড়ে কিভাবে হরি ধানের সৃষ্টি তার কৃতিত্বগাঁথা কাহিনী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলে ফলাও করে প্রচার করা হয়। শুরুটা ছিল এইরকম, কৃষক হরিপদ কাপালীর জমিতে বিআর ১১ জাতের ধান খেতে উঁচু একটি অন্য জাতের ধান গাছ দেখতে পান। এটি আগাছা ভেবে ফেলে না দিয়ে সযত্নে কৃষক হরিপদ সেটি সংরক্ষণ করেন। সেই একটি গাছের ধানের শীষ থেকে তিনি পরের বছর আবারো কিছু জমিতে রোপণ করেন চারা। এভাবে তিনি পার করেন তিন বছর। তার উদ্ভাবনী প্রয়াস তখনও আসাননগর গ্রামের মানুষের ছিল ধারণার বাইরে।
হরিপদ কাপালীর বর্ণনামতে, ১৯৯৯ সালে তিনি নিজ জমিতে এই ধানের আনুষ্ঠানিক আবাদ শুরু করেন। ওই বছরই আলোড়ন সৃষ্টি করে হরি ধান। চারিদিক এই ধানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ধান কাটা শুরু হলে আশপাশ গ্রামের কৃষকরা বীজ নিয়ে তারাও পান বাম্পার ফলন। এরপর থেকে হরি ধানের আবাদ বিস্তার লাভ করে এ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, জেলা থেকে অন্য জেলায়।
সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে হরি ধানের বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে মহেশপুরের দত্তনগর কৃষি ফার্ম ও সাধুহাটি খামারে চাষ হয়। হরি ধানের বৈশিষ্ট্য দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যান কৃষিবিদরা। এ বছর নানা প্রতিকূল পরিবেশে যখন কৃষকের মুখে বিষণ্নতার ছাপ তখন হরি ধানই তাদের মনে আশার আলো ছড়িয়েছে।
হরি ধানের বৈশিষ্ট্য দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যান কৃষিবিজ্ঞানীরা। তারা জানান হরি ধানে রোগপ্রতিরোধ মতা বেশি এবং অতিবৃষ্টি সহনীয়।
ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া জেলার অনেক জমিতে এখন এই ধান চাষ হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ফলন ১৮ থেকে ২০ মণ। ধানের কান্ড পুরু ও বিচালি শক্ত। মোটা চাল। ভাত মোটা হলেও অনেক সুস্বাদু।
কৃষিতে অন্যন্য অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া সরকার তাকে একটি বাড়ি তৈরি করে দেয়। সেই বাড়িতেই স্ত্রী সুনিতা রানী (৭৫) ও পলিত পুত্র রুপকুমারকে নিয়ে থাকতেন তিনি। এলাকার মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করতেন।
হরিধান’ উদ্ভাবনের পরই মূলত হরিপদ কাপালীর নাম গণমাধ্যমে আসে এবং সারা দেশে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষকদেরও নজর কাড়েন। মানুষ তার ধান সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং এ ধানের চাষ শুরু করেন। তবে এখন আরো উচ্চফলনশীল ধান বাজারে আসায় ‘হরিধানের’ চাষ তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।
একে একে ১২ বছর আশানুরূপ ফলনের পর বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে এ বছরও সাড়া জাগিয়েছে উফশি ধান ’হরি’। নাম না জানা অজ্ঞাত এই ধানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ কৃষকরা। প্রতিবছরের ন্যায় চলতি আমন মৌসুমেও ঝিনাইদহ অঞ্চলের কৃষকরা হরি ধানের আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার মাঝেও হরি ধানের সোনালী ঝিলিকে কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে ফুটে উঠেছে নবান্নের হাসি।
বাড়ির কাছে আলীয়াপুর শ্মশানঘাটে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় এই মহান উদ্ভাবককে সমাহিত করা হয়েছে। মহান উদ্ভাবককে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শাহ মতিন টিপু : সাংবাদিক, লেখক।