নিউইয়র্কে বাংলাদেশ!

সুলতানা রহমান

গ্রীষ্মে নিউ ইয়র্কে পড়ন্ত বিকেল মানে রাত আটটা! রোদের তাপ কমে এক মোহনীয় আলোক রশ্মি দ্যুতি ছড়ায়। ফুরফুরে হাওয়ায় উবে যায় সারাদিনের জ্বালা ধরানো উত্তাপ। এমন বিকেলে হিলসাইডে বাঙ্গালী পাড়ায় হাটতে হাটতে হারিয়ে গেলাম বাংলাদেশের চিরচেনা সবুজ গ্রামে। না, কল্পনায় নয়, বাস্তবে।

লাউয়ের মাচায় উকি দিচ্ছে সাদা সাদা ফুল, বাতাসে লকলক করছে কচি কচি ডগা। লাউয়ের পাতাগুলো এতো সুন্দর জিভে পানি এলো-আহা স্বাদের লাউ পাতা চিংড়ি মাছের ভর্তা! লাউয়ের মাচার নিচে বেগুন টমেটো উকি দিচ্ছে। ঘরের দাওয়ায় বসে খোশগল্পে মশগুল মেয়ে বউ শাশুড়ি। পাশেই আপন মনে খেলছে ছোট শিশুরা। শীতকালে আবহমান গ্রাম বাংলার উঠোন লাগোয়া যেনো পৌষের দুপুর গড়ানে বিকেল! হাটতে হাটতে নিউ ইয়র্কে রাস্তার দুধারের এমন দৃশ্যে আত্মভোলা মনে চৈতন্য এলো পেছন থেকে আসা নারী কন্ঠের বাংলা চিৎকারে-‘তোর দুই পা ধইরা ছিড়া ফালামু!’ আচমকা ঘুরে তাকালাম,১৩/১৪ বছরের মেয়ের উদ্দেশ্য বলছে একজন মধ্য বয়ষ্কা নারী। সম্ভবত মা মেয়ে। লিকলিকে গড়নের দুজনেরই মাথার হিজাব। প্যান্ট টি শার্ট পরা মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ খিচিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে সোজা হেটে গেলো! মা বিড়বিড় করছে।

মনে পড়লো কয়েক মাস আগে এই বয়সেরই বাংলাদেশি একটি মেয়ে ট্রেনের নিচে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। পরে জানা গেলো, অতিরিক্ত শাসন আর ঘরে বাইরে ভিন্ন সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট হতাশায় ভুগছিলো মেয়েটি। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশি এক মা তার দুই মাসের সন্তানকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। সেই মা এখন জেলে। তার চরম বিষন্নতা ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে হাটতে হাটতে হঠাৎ পরিচিত এক ভাবির সঙ্গে দেখা। পথের ধারে সিড়িতে বসে গল্পরত তার শাশুড়ি এবং শাশুড়ির বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ফোকলা মুখে দুই বান্ধবী মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-বাড়ি কোথায়? এ কথা সে কথার পর বললেন-প্যান্ট গেঞ্জি না পরে ছেলের বউয়ের মতো সালোয়ার কামিজ পরি না কেন! বললাম-আমি তার ছেলের বউয়ের মতো ‘ভালো মেয়ে’ নই! বহু বছর পর এমন কথা শুনে হাসতে হাসতে তাদের পানের ডিব্বার দিকে হাত বাড়াই, পান খেয়ে আবার চলতে শুরু করি।

মাথায় ঘুরছে মা মেয়ের সেই বাক্য! আমেরিকায় অভিবাসিদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন একজনের সঙ্গে দেখা। তাকে বললাম ঘটনাটি। খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন- এদের নিয়ে আর পারিনা! কেউ অভিযোগ করলেই মেয়েটিকে পুলিশ নিয়ে যেতো এবং শেলটার হোমে পাঠিয়ে দিতো। বাংলাদেশি একটি পরিবারের চলমান এমন এক ঘটনার কথা বললেন। এক মা তার মেয়েকে মেরে হাতে দাগ ফেলেছে। স্কুলের সহপাঠিরা তা দেখে টিচারকে বলেছে। টিচার জানিয়েছে পুলিশকে। পুলিশ তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে। ওই মায়ের দুই মেয়ে এখন শেলটার হোমে আর মাকে পাঠিয়েছে কারেকশন সেন্টারে! বড় মেয়েটি পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে-মা মারেনা, কিন্তু পুলিশ বিশ্বাস করেনি!

লেখিকা : প্রবাসী সাংবাদিক

(লেখিকার ফেসবুক পেইজ থেকে )

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts