শাহ মতিন টিপু : গৌরবের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে সময়ের প্রয়োজনেই জন্ম ছাত্রলীগের। গৌরবের শিরোপা মাথায় নিয়েই ছাত্রলীগ আজ তার ৬৮তম বসন্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য আছে, তেরি পথে কখনো হাঁটেনি ছাত্রলীগ। বরং পথ তৈরি করে নিয়েছে বার বার। অহর্নিশ লড়াই সংগ্রামে ইতিহাসের অগ্নিগর্ভে জন্ম নিয়েছে ৫২, ‘৬২, ‘৬৯ এবং অবশেষে ‘৭১। সেই ছাত্রলীগে কোন অপশক্তি নতুন করে ভর করতে পারে না। পিঠে চেপে বসলেও ছিটকে পড়বে ঘোড়ার পিঠে বসা অচেনা সহিসের মতো। যে শক্তি চিরদিন সৃষ্টি করেই গেছে, সে শক্তি ধ্বংস এবং বিনাশের হতে পারে না।
১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম। বৃটিশ পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানি পরাধীনতায় প্রবেশের এক বছরের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেদিন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে রেখেছিলেন দুই যুগ। আজ ইতিহাসের সাধারণ পাঠক মাত্রই জানেন, বাংলা ও বাঙালির যা কিছু সোনালী অর্জন তার সবকিছুরই গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
পৃথিবীর দেশে দেশে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে সময়ের প্রয়োজনে জন্ম নিয়েছে অনেক সংগঠন। অতঃপর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সময়কে। বছরের পর বছর লড়াই সংগ্রামের আগুনে পুড়ে খাক হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। ১৭ হাজার নেতা কর্মীর শাহাদৎবরণের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বের গৌরবে গরীয়ান আজকের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশেই যেন ছাত্রলীগ লড়াই করেছে ইতিহাসেরই শত্রুর বিরুদ্ধে। অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে কার্যকর এই গঠনতন্ত্র এখন বাঙালির সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। তারপর ১৯৬৫, ৬৬, ৬৭, ও ৬৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় রদবদল করা হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে ১৯৭২, ’৭৬, ’৮৬, ’৯২, ও ’৯৪ সালের পর ২০০২ সালের সম্মেলনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। চলার পথে পাথেয় হয়েছে হাজার বছরের ইতিহাসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শিক প্রেরণা। জাতির জনকের ভাষায়, নেতার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু’ সংগঠন বেঁচে থাকলে আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না।
এ কথা আজ নিদ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা এবং বাঙ্গালীর ছয় দশকের সংগ্রাম স্বপ্ন এবং সাহসের সারথী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশিদার এই ছাত্র সংগঠনটি। জাতির ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে জন্ম গ্রহণের আতুর ঘর থেকে শুরু করে আজ অবধি স্বাধীনতা, সংগ্রাম আর শিক্ষার নিশ্চয়তার জন্য ছাত্রসমাজ তথা দেশবাসীর কাছে আলাদা পরিচয়ে জাগ্রত ছাত্রলীগ।
বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র। তিনি ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পর বাঙ্গালীরা নতুন ভাবে শোষনের যাতাকলে পড়ে। প্রথমে আঘাত হানে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার উপর। শেখ মুজিব তখনই অনুভব করলেন শোষনের কালো দাঁত ভাঙ্গার একমাত্র হাতিয়ার ছাত্র সমাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রতিষ্ঠা করেন ‘পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু।
সংগঠনটির প্রথম আহবায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ভাবে কার্যত্রক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনিত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মনোনিত হন খালেক নেওয়াজ খান।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে এই ছাত্র সংগঠনটির হাত ধরেই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’। যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। তৎকালিন সরকারের শাসন শোষন আর বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জন্মের পর থেকে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতা কর্মী যুদ্ধের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রনাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ছাত্রলীগের ১৭ হাজার সাহসী বীর সৈনিক। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও ছাত্রলীগ থেকেই। ১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপোষহীন অবস্থান তৈরি করে। ১১ মার্চ ছাত্রলীগ উর্র্দুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট পালন করে।ওই ধর্মঘটের পিকেটিং থেকেই গ্রেফতার হন রাজনীতির মাঠের জ্জ্বলজ্জ্বল করে থাকা তারকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাঙ্গালীর রাজনীতির রাখাল রাজা,ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগই প্রথম বাংলাভাষার জন্য ১০ দফা দাবিনামা পেশ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অবিস্মরনীয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশান উড়ানোর নেপথ্যের কারিগরও ছিলো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালের বাংলা রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ৫৭’র শিক্ষক ধর্মঘট এবং ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা আজও আলোচিত।
-রাইজিংবিডি থেকে