শেষ রাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সমাধান কি?

আখতার-উজ-জামান  ||  শেষ রাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ৬.৭ ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সারাদেশের ঘুমন্ত মানুষ। আর এই আতঙ্কের মাঝে ৫ জনকে জীবন দিতে হলো বড় ধরনের এই বিপর্যয়ের ফলে। আহত হয়েছে শতাধিক। রাজধানীবাসীর বেশিরভাগ মানুষ বাসার ছাদে কিংবা রাস্তায় নেমে যায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে।

ভূমিকম্পের কারণে সারাদেশের মানুষের মধ্যে বড় ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে, তার কারণ হয়তোবা দু’একবার ভূকম্পন হলে পুণরায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবারও অনুভূত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আনুমানিক ভোর ৪:৩০ মিনিট ১৪ মাসের কারীব হঠাৎ কান্না করে জেগে ওঠল। তার কান্নায় আমি ও কারীবের মাও জেগে গেলাম। তাই দুজনেই জেগে যাওয়া মাসুম বাচ্চাটিকে ভেঙ্গে যাওয়া পুণরায় ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছি। কারীব ও তার মা ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আবারও গভীর ঘুমে। আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হয়তো প্রতি সুবেহসাদেকের মতোই সবাই ঘুমের ভাবেই। ঘড়ির কাটা তখন ভোর ৫:০৫ মিনিট। কেঁপে ওঠল ৬ষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটটি। মুহূর্তেই মাথাটা ঘুরে উঠল। ভয়ঙ্কর অনুভূতি যেন শরীরের কোন গুরুত্বপূর্ণ হৃদয় স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম; যা আমরা হার্ট এ্যাটাক বলে থাকি।

এরপরই আমার বাচ্চা আর তার মাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করছি, দেখো আমাদের চার দেয়ালের কামরাটি কেমন যেন কড়মড় শব্দ করছে। মনে হলো পুরো পৃথিবী ঘুরছে আর দুলছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মনে হলো, না এ ধরনের কিছু নয়। ভূমিকম্প হচ্ছে। আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল।

আশপাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের যার যার অবস্থান থেকে রাস্তায় নেমে হুই হুল্লুড় করছে। এ কি আবারও বড় ধরনের ভূমিকম্প। ভোর ৫:০৬ মিনিটে কেঁপে ওঠল বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল। যেটি ছিল গত বছরের ২৫ এপ্রিল আনুমানিক দুপুর সোয়া বারোটার মতো। হঠাৎ রিমোর্ট হাতে নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো ঘাঁটতে লাগলাম, সত্যিই চোখে পড়ল বেসরকারী চ্যানেল এটিএন বাংলায় ব্রেকিং স্ক্রলে যাচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশে রিখটার স্কেলে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত। ঠিক এর পরেই এটিএন নিউজসহ সব প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো ভূমিকম্পের খবর প্রচার করছিল।

তারপরই খবর আসলো ভূমিকম্পের আতঙ্কে ঢাকা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও লালমনিরহাটে পাঁচজনের মৃত্যুসহ আহত শতাধিক। এমনকি কোথাও কোথাও দেয়ালে ফাটল ও ভবন হেলে পড়ার খবরও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হতে লাগল।

আমার মত হয়তোবা রাজধানী ঢাকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ও লাখ লাখ মানুষের করুণ মৃত্যুর আশঙ্কার হাত থেকে বিধাতা রক্ষা করেছেন।

এর আগে গত বছর এপ্রিলে নেপালে ৭.৯ মাত্রার যে ভূমিকম্প আঘাত করেছে, তারও আঁচমাত্র লেগেছে বাংলাদেশে। আর এবার ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প- যান উৎপত্তিস্থল ভারতের মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলের ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে মাটির ৫৫ কিলোমিটার গভীরে এ ভূমিকম্প হয়।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই ঢাকা শহর পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। এর অন্যতম কারণ ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম-কানুন মানার বালাই নেই। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৭৮ হাজার। এর মধ্যে সরকারি ভবনই ৫ থেকে ৬ হাজার। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসেবে প্রায় ৭২ হাজার। তাই চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। যাতে ভবিষ্যতে এইসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কেউ নির্মাণ না করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভে ইন্ডিয়া প্লেট, উত্তরে তিব্বত সাব প্লেট আর পুবে বার্মা প্লেটের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। আর সোমবারের ভুকম্পনের উৎপত্তিস্থল ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে। যা সবসময় সক্রিয়।

ভূমিকম্প হবে, এমন পূর্বাভাস দেয়ার মতো কোন যন্ত্র আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। কেবল ভূমিকম্প হওয়ার পর কত মাত্রায় হয়েছে, তা মাপার যন্ত্র রিখটার স্কেল আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ভূমিকম্প হওয়ার আগমুহূর্তে প্রাকৃতিক কিছু অনুমান (symptom) দেখে আঁচ করা যায়।

এই উপমহাদেশে এখন যারা এখন বেঁচে আছেন, তাদের কারো পক্ষেই ৭.৯ মাত্রার মতো ভয়াবহ ভূমিকম্প অনুভব করার অভিজ্ঞতা নেই। কারণ এই মাত্রা বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছিল ৮০ বছর আগে নেপালে।

ভূকম্পন কৃত্রিম না প্রাকৃতিক বিপর্য। এর কোন হাত নেই যে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কোন কৃত্রিম যন্ত্র দিয়ে প্রতিহত করা যায়। ধীরে ধীরে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে ভূমিকম্প আরও শক্তিশালী রূপ নিতে যাচ্ছে। এই বিপর্যয়ের জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভৌগোলিক সীমারেখায় যেকোন স্থানে এর উৎপত্তিস্থল হতে পারে।

বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায় কারণ বাংলাদেশে আসলে ভারত ও মায়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যতির প্রভাবে আন্দোলিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার পর দুই-তিন দিনের মধ্যে আরও বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।

এবার ভূমিকম্পের বিপদ থেকে কিভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায় সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেককেই ভূমিকম্পের সময় দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। কারণ, এই ছোটাছুটি অনেক সময় আরও বেশি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ভূমিকম্পকালে দিশেহারা ছোটাছুটি না করে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। ভবনের উঁচু তলার দিকে থাকলে কিংবা ভূমিকম্প রাতে হলে দ্রুত বের হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভবনের ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে।

ভবনের এমন কোনো দেয়ালের পাশেও আশ্রয় নিতে পারবে, যে দেয়ালটি বাইরের দিকে। যেন সেই একটি দেয়াল ভেঙে উদ্ধার করা যেতে পারে। আশ্রয় নেওয়ার সময় মাথার ওপর এক বা একাধিক বালিশ নিয়ে রাখা প্রয়োজন। যেহেতু মাথার চোট বাঁচানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়া, কোনো শক্ত টেবিলডেস্ক বা নিচে জায়গা আছে এমন শক্ত ও দৃঢ় আসবাবের নিচে আশ্রয় নিতে হবে এবং গুটিশুটি হয়ে বসে থাকতে হবে। কারণ ভূমিকম্পের পর পরই আবারও কম্পন হতে পারে, যাকে বলা হয় ‘আফটার শক’ বা পরাঘাত। ভবন ধসে পড়ার সময় ছাদ ধসে পড়লে সেটা যার ওপরে পড়ে, ঠিক তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। একে বলা হয় ‘সেফটি জোন’। তাই ভূমিকম্পের সময় সোফা বা এ ধরনের বড় শক্তিশালী আসবাবের পাশে গুটিশুটি মেরে বসে থাকাটাই প্রয়োজন বলে মনে করি।

দেখা যায়, ভূমিকম্পের আতঙ্ক থেকে হুট করে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া, তাড়াহুড়ো করতে দিয়ে আহত ও নিহতের ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘটতে পারে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস বিপর্যয়। তখন লিফট হয়ে উঠবে মরণফাঁদ। ভূমিকম্পের পর পরই গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগগুলো পরীক্ষা করে নিতে হবে। ভূমিকম্পের ফলে এসব সংযোগে সমস্যা হতে পারে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের প্রধান সংযোগগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কোথাও কোনো লিক বা ক্ষতি পদখলে আগে মেরামতের উপায় খুঁজতে হবে। যদি ভবন ধসে আটকা পড়েন, বেরিয়ে আসার কোনো পথ খুঁজে না পান, আশা হারাবেন না। সাহস রাখুন। সাহস আর আশাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। উদ্ধারকারী পর্যন্ত আপনার চিৎকার বা সংকেত পৌঁছানো যায় কী করে, কৌশল খুঁজে নিতে হবে।

পরিশেষে ভুমিকম্পে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল চিহ্নিত করে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে বলে আমি মনে করি।

azamansun@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts