অসিত রঞ্জন মজুমদার
ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নামধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন।
তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারী মূর্তিতে কল্পনা করেছেন। আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দেবী দুর্গা কখনও ত্রিভুজা, কখনও অষ্টভুজা, আবার কখনও দশভূজা হিসেবে আবির্ভূত হন।
সনাতন ধর্ম মতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দুর্গাপূজা মূলত শক্তির আরাধনা। এর দর্শনটি হলো, দুর্বলের কোনো আত্মজ্ঞান হয় না, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণতা লাভ করেন শক্তিতে। শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ণ ঘটে জগৎসৃষ্টিতে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় পূজা হলো দুর্গাপূজা। মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে, দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবাধ্য ছিলেন বলে বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ থেকে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন।
এরপর মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুদের তেজে হাতের আঙুল, কুবরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রু, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো।
এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র ও অস্ত্র দান করলেন। এ ক্ষেত্রে যাঁরা যা দান করলেন, তা হলো- মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তৃণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদ, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অমালা ও কম লু. সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখডুগ ও নিমল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পানপাত্র, শিষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতারা তাঁদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন।
এরপর দেবতারা সমবেতভাবে তাঁকে সম্মান দেখানোর সাথে সাথে দেবী অট্টহাস্য করতে লাগলেন। তাঁর হাসিতে পৃথিবী কম্পিত হতে লাগল। অসুররা এই কম্পনের কারণ জানতে এসে দেবীকে দেখল। এরপর দেবীর সাথে অসুরের যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধে মহিষাসুরের পক্ষে যে যে সেনাপতি বিশাল বাহিনী নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা হলো- চামর ও চিক্ষুর: চতুরঙ্গ সৈন্য মহাহনু: অযুত হাজার রথ ও সৈন্য অসিলোমা: পঞ্চাশ নিযুত রথ ও সৈন্য বাস্কল: ষাট লক্ষ সৈন্য, সহস্র হাতি ও এক কোটি রথ, বিড়ালা: অযুত সৈন্য ও পঞ্চাশ অযুত রথ।
অন্যান্য ছোটখাটো সেনাপতিরা তাঁদের সাধ্যমতো সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। এ সময় মহিষাসুর নিজে কয়েক কোটি রথ, হাতি, অশ্ব ও সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
অসুরদল দুর্গাকে আক্রমণ করলে মা তা অবলীলায় প্রতিহত করলেন। তারপর মা দুর্গা শ্বাস ত্যাগ করলে শতসহস্র প্রথম সৈন্য সৃষ্টি হলো। এই সৈন্যরা পরশু, পট্টিশ, অসি ও ভিন্দিপালের আঘাতে অসুরদের হত্যা করতে লাগল। দেবী ত্রিশূল, গদা, শক্তি, খড়গ ব্যবহার করে অসুরদের বিনাশ করতে লাগলেন।
ক্রমে সকল সৈন্য ও সেনাপতিরা নিহত হলে মহিষাসুর নিজে মহিষের রূপ ধরে সারা পৃথিবী ক্ষুব্ধ করে দেবীর মুখোমুখি হলো, দেবী তাকে পাশ দিয়ে বেঁধে ফেললেন। এ অবস্থায় মহিষাসুর তার মহিষরূপ ত্যাগ করে সিংহের রূপ ধারণ করলো। এই সময় দেবী তার শিরশ্ছেদ করলেন। সাথে সাথে অসুর খড়গধারী পুরুষ মূর্তিতে উপস্থিত হলো। এবার দেবী সেই মূর্তিকে তার খড়গসহ কেটে ফেললেন, অসুর হাতির রূপ ধরল। তারপর শূড় দিয়ে দেবীর বাহন সিংহকে টানার চেষ্টা করলে দেবী শূড় কেটে দিলেন। এবার অসুর পুনরায় মহিষের রূপ ধরে পুনরায় ত্রিলোক তছনছ করে বেড়াতে লাগল। দেবী অমৃত পান করে ক্রোধে হাসতে লাগলেন। অসুর শিং দিয়ে পর্বত উত্তোলন করে দেবীর ওপর নিক্ষেপ করলে দেবী শর নিক্ষেপ করে তা চূর্ণ করে ফেললেন।
এরপর দেবী মধুপান করে মহিষাসুরের উপর লাফিয়ে উঠে পায়ের নিচে চেপে ধরলেন। তারপর গলার উপর পা রেখে শূল দ্বারা আঘাত করলেন। এরপর মহিষের মুখ থেকে অসুরের নিজ মূর্তির অর্ধাংশ বের হওয়ার সাথে সাথে দেবী তাকে বেঁধে ফেললেন। এই অবস্থায় অসুর যুদ্ধ করতে থাকলে, দেবী খড়গ দিয়ে তার শিরশ্ছেদ করলেন। এরপর দেবতা ও ঋষিরা দেবীর বন্দনা করলেন। দেবতারা বললেন, তাঁরা এরূপ বিপদে পড়লে, দেবী যেন পুনরায় তাঁদের উদ্ধার করেন। দেবী সেই বর দিয়ে অন্তর্হিত হলেন।
কথিত আছে, দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার হত্যা করেন। প্রথমবার মা অষ্টভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভুজা দুর্গারূপে। মহিষাসুরের অনুরোধে মহিষাসুর দুর্গার উক্ত তিন ধরনের মূর্তির সাথে পূজিত হয়ে থাকেন।
মূল কথা হলো- শক্তির জন্য আমরা দুর্গাপূজা করে থাকি। জগতের কল্যাণ কামনায় মাকে হৃদয় মন্দিরে ধারণ করি। দর্গা মূলত শক্তি দেবী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তার দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলো হলো: মৎস্যপুরাণ মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামেও পূজিতা হন।
বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে- আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুকপে বাসন্তী দুর্গাপূজা। মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। মানুষের দেহ একটি দুর্গ বিশেষ। পঞ্চভূতে নির্মিত যথা- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুদ, ব্যোম। দেহের মূলশক্তি প্রাণশক্তিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য- এ ষড়রিপু আক্রমণ করে। সাধক সাধনাকালে মহাশক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার জন্য উদ্যোগী হয়। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাধে সংঘর্ষ।
আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশদিক রা করার প্রতীক, দশপ্রহরণ এক এক দেবতার সাধনলব্ধ বিভৃতি। দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকাশক্তির প্রতীক অর্থাৎ সত্ব, রজঃ ও তমগুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী- একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, একটি সূর্যস্বরূপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর- দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এবং ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বোপরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক।
দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শুদ্রশক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশকিরত, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক। শক্তিসমূহ অনুভূতির বিষয়। অনুভূতির আকার নেই। আকার দেয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য। সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা। প্রকৃতপক্ষে সর্বকালের সকল অশুভ ও আসুরিক শক্তি ধ্বংস করে সকল অত্যাচারীর হাত থেকে পরিত্রাণের মানসে শক্তি সঞ্চারের জন্যই আমরা দুর্গাপূজা করে থাকি।
অসিত রঞ্জন মজুমদার : মহাসচিব, বাংলাদেশ হিন্দু যুব কল্যাণ সমিতি