‘আজি এল হেমন্তের দিন /কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুহেলীবিলীন-ভূষণবিহীন হেমন্তের প্রথম দিন আজ।শরৎ আর শীতের মধ্যস্থ ঋতু হেমন্তের না আছে শীতের কুহেলী, না আছে শরতের ভূষণ।
ঋতুচক্রের পরিক্রমায় শরতের পরে শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষণ্ন প্রকৃতির মেদুরতাহীনতায় আবির্ভূত হয় হেমন্ত । আভাময় পাকা ধান মাঠে মাঠে শোভা পেতে থাকে। সোনা ধান ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে কৃষকের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তির নির্মল হাসি।
সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব বহুকাল থেকেই। মানুষ প্রকৃতির সন্তান তাই প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য রচয়িতা কবিদের পক্ষে তো নয়ই।
মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্ত’র বর্ণনা এভাবে- ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ/যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’।
মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতে হেমন্তের নতুন ধান্যে কৃষকের ঘরে ঘরে সুখের আবেশ ছড়ায়। এ সময়ে তারা পরম তৃপ্তিতে সুখস্মৃতি নিয়ে আনন্দ বিলাসে মেতে ওঠে। বৈষ্ণব পদকর্তা লোচনদাসের পদে- ‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/ সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে / পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।/ সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে।’
বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস রচিত পদে – ‘আঘ্রাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/ পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/ বৃন্দাবন বন ভেল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে- ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/ জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার /স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ (নৈবেদ্য)
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়- ‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া/সেই নাচনে উঠল মেতে। / টইটুম্বুর ঝিলের জলে/ ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে/ চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে/ সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায়- ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,/ সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।/ ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু/ কলমিলতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’ (নকশীকাথার মাঠ)
জীবনানন্দ দাশের কবিতায়- ‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা/ রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি/ পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,/ ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি/ তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে ক্ষেতের ভিতর/এখনি সে নেই যেন ঝড় পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ন সোনালি।’
সুফিয়া কামালের কাব্যে- ‘হেমন্তের কবি আমি, হিমাচ্ছন্ন ধূসর সন্ধ্যায় / গৈরিক উত্তরীয় টানি মিশাইয়া রহি কুয়াশায়।’ আবার ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন পাথারের ওপার থেকে /আনল ডেকে হেমন্তকে?’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় – ‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত লোহিত/ তরুণ তরুণী শূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,/ শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ, নিশাক্রান্ত বিষণ্ন বলাকা/ম্লান চেতনারে মোর আকস্মাৎ করেছে মোহিত।’
বুদ্ধদেব বসুর কবিতায়- ‘পউষে ফাল্গুন গাঁথা কান্না-হাসি দোলানো অন্যায় / আমাকে বেঁধে না আর, বড়ো জোর রাত, পিত্ত, শ্লেষ্মার সংবিৎ/এঁকে যায় যায় সামান্য গণিত চিহ্নে পঞ্জিকার পালা’।’
আল মাহমুদের কবিতায়- ‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে/ আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে/ রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে/ আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর /বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো কট ও কষায়।’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়- ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।/ তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন/কতকালের পুরনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে/ তাই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি/ আমি দেখেছি কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে/ বকের মতো নিভৃত মাছ।’ (হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান)
আধুনিক কালের প্রায় সব কবিরই রচনায় কোনো না কোনোভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ বিদ্যমান । অনবদ্য নান্দনিকতায় হেমন্ত মিশে আছে আমাদের সকলের জীবনে।
শাহ মতিন টিপু : কবি, লেখক।