মোতাহার হোসেন
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমার ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসের মধ্য দিয়ে হতাশার মধ্যে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চাপ অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের একজন মন্ত্রী ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকা সফর করেছেন। এ সময় প্রতিনিধি দল পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মূখ্য সচিবের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে’ আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মিয়ানমার। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার সরকার। তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য উভয়পক্ষ মিলে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। এই কমিটিই নির্ধারণ করবে কি প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে।
অধিক জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের অর্থনীতি। ৯ থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়, ভরন-পোষণ, তাদের চিকিসাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধুমাত্র মানবিক বিবেচনায় ‘ বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের পরম মমতায়,মায়ের স্নেহে বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিলেন’। তাঁর এই মহানুভবতায় পুরো দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। একই সাথে তাঁকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রশংসা করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। একই সাথে এই সাহসী ও মানবিক উদ্যোগের কারণে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব পরিমন্ডলে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘চুক্তির খসড়াও তাদের (মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে দুই পরে মধ্যে আলোচনা হয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে আছেন। তিনি খুব দ্রুতই মিয়ানমার যাবেন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে চাই।
চুক্তির বিষয়ে মন্ত্রী জানান, ‘আমরা প্রস্তাবটি হস্তান্তর করেছি। তারা এখন এটি নিয়ে যাবে। যাদের রোহিঙ্গা হিসেবে আগে থেকে শনাক্ত করা আছে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘চুক্তিটা আগে হোক, তারপরে বিষয়টি ঠিক করা হবে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ আলোচনা পাঁচ দফা সম্পর্কিত নয়। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। প্রক্রিয়াটি শুরু হলো। আনান কমিশনের রিপোর্টের বিষয়টি আলোচনায় তোলা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্র“প’ গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা উভয়ে সম্মত হয়েছি।এই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্র“পের কম্পোজিশন কী হবে- সেটা আমরা বাংলাদেশও ঠিক করব, ওরাও ঠিক করবে। তাদের সম্মতিটা হয়েছে এই আলোচনায়।
রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বলছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মিয়ানমারের নেত্রী সু চি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে।
রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত মাসের শেষ দিকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের উপর যে সহিংসতা হয়েছে তা মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সম্প্রতি মিয়ানমার ঘুরে আসা ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, অং সান সু চি সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে চান বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন। এদিকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উ উইন মিত আয়ে রাখাইনের মংডু এলাকায় ‘যত দ্রুত সম্ভব’ রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায় নির্বাসিত বার্মিজদের ওয়েবসাইট ইরাবতী। সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসনের জন্য দুই বিলিয়ন কিয়াটের একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, যাতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার ১৯৯৩ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় শরণার্থীদের নিবন্ধন করা হবে। মংডুর দারগিজার গ্রামে পুনর্বাসনের আগে তাংপিও লেতওয়ে ও না খুয়ে ইয়া গ্রামে তাদের নিবন্ধন হবে।
মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি উ মিন্ট কেইং ইরাবতীকে বলেন, দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যাদের মনোনীত করা হবে তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দেওয়া হবে। রোহিঙ্গা’ স্বীকৃতি না থাকায় এই মুসলিম জনগোষ্ঠী ওই এনভিসি নিতে আপত্তি জানিয়ে আসছিল বলে ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে মিয়ানমার সরকার শিগগিরই বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেন। একই সাথে সে দেশে তাদের মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। একই সাথে বাংলপদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সকল প্রকার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক. কলামিস্ট।
motaherbd123@gmail.com