টেকসই পরিবর্তন আমার হৃদয়কে ছুঁয়েছে

ফারহানা আমিন

গাজিপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বাস্তবায়ীত স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচী দেখলাম। স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়নকারী বেসরকারী সংস্থা র্ডপ এর উপজেলা সমন্বয়কারী জনাব মোঃ ইসমাইলের সহযোগিতা নিয়ে সম্প্রতি কালীগঞ্জের তুমুলিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল ঘুরে বেড়াই। স্বপ্ন মা’দের বাড়ী বাড়ী যাই। তাদের লাইফস্টোরী জানতে পারি, কিভাবে তারা স্বপ্ন প্যাকেজের আওতায় এসেছেন? তুমুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারীখোলার স্বপ্ন মা লাকী বেগমের বাড়ী। সে ২০১১ সালে স্বপ্ন প্যাকেজ পেয়েছে। ঘন্টা ব্যাপী লাকী বেগমের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করি, লাকী বেগম আমাদের জানান যে, মাতৃত্বকালীন ভাতা কিভাবে পেয়েছেন ? ভাতা পাওয়ার উদ্দেশ্য কি কি ?

এ সকল প্রশ্নের উত্তরে লাকী বেগম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মহিলা মেম্বারদের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করার পর মাতৃত্বকালীন মা’দের চুড়ান্ত তালিকা করা হয়। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিসের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩৫০/- টাকা করে ২৪ মাস পর্যন্ত এই ভাতা পেয়েছেন।

তিনি আরো জানান, গর্ভকালীন সময়ে মাকে সুস্থ রাখা এবং গর্ভকালীন সন্তানকে সুস্থ সবল মেধাবিকাশ করার জন্য মায়ের গর্ভকালীন সময় থেকেই বাড়তি পুষ্টিকর খাবার যেমনঃ দুধ, ডিম, মাছ ইত্যাদি খাবারের মাধ্যমে পরিচর্যার জন্য সরকার এই ভাতা প্রদান করেন। যাদের মাসিক আয় ১৫০০/- টাকার নীচে, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যাক্তা, দুই সন্তানের অধিক নয় এমন মা প্রথম সন্তান বা দ্বিতীয় সন্তানের বেলায় এই ভাতা প্রাপ্ত হবেন।

গত ১৮/০৮/২০১৭ তারিখে লাকী বেগম আরো জানান, এর আগে অনেক দুঃখে কষ্টে দিনাতিপাত করতেন। স্বামী দিন মজুরের কাজ করতেন। এই সামান্য আয় দিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হতো। নিজের থাকার কোন ঘর ছিল না, শশুরের ঘরের বারান্দায় থাকতেন। মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়ার পর স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচীর আওতায় তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতেন, কিভাবে বাড়তি আয় করা যায়, স্বাস্থ সচেতন হওয়া যায়, বাড়ীর আঙ্গীনায় শাক-সবজি চাষ করা যায়, শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করা, কিভাবে পরিবারের সকলে শিক্ষার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। আগে নিজের মত প্রকাশ করতে পারতেন না। এখন নিজের মতামতকে সকলের নিকট বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লাকী বেগম আজ নিজেকে অনেকটাই পরিবর্তন করতে পেরেছেন। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কিছু জানেন যা, প্রত্যহ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কাজে লাগছে। স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচীর মাধ্যমে একটি আবাসন (থাকার ঘর) পেয়েছেন আয়ের জন্য একটি গাভী পেয়েছেন, বর্তমানে তার ০৩ (তিন) টি গাভী হয়েছে গাভী দুধ দেয়, পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে দুধ বিক্রি করে ভাল আয় করেন। স্বামী এখন আর দিন মজুরের কাজ করে না। নিজে একটি অটো গাড়ী কিনেছেন তা থেকে মাসে ২০০০০/- (বিশ) হাজার টাকা আয় হয় তা দিয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে আছেন। যা লাকী বেগমও পরিবারের উন্নতির পরিবর্তনের চিত্র।

আমি (ফারহানা আমিন) অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং আবেগে আপ্লুত, এই জন্য যে, লাকী বেগমের পরিবারের এই উন্নতি আমার হৃদয়কে ছুঁয়েছে, আমি ০৩টি স্বপ্ন মা’দের বাড়ীতে যাই সকলেরই প্রায় একই রকম ভাল পরিবর্তন হয়েছে। আমি তাদের সকল তথ্য ও ছবি নিজের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষার জন্য সংরক্ষণ করলাম। তুমুলিয়া ইউনিয়নের আরেক স্বপ্ন মা রুমা বেগম। তার আবাসন দেখলাম ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সম্পর্কে জানলাম। গ্রামের কাঁচামাল ও শাক-সবজি কিনে প্রতিদিন টঙ্গি শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। এ থেকে তার ভাল আয় হয়। স্বামী সন্তান নিয়ে খুব ভাল আছেন।

বক্তেরপুর ইউনিয়নের স্বপ্ন মা উমা রাণী, স্বামী শ্যামল চন্দ্র পাল স্বপ্ন প্যাকেজ হতে একটি আবাসন ঘর ও ক্ষুদ্র ব্যবসা (মৃৎ শিল্প) মাটির হাড়ী পাতিল বানিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। বর্তমানে তার অবস্থা অনেক উন্নতি হয়েছে।

স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচী ও মাতৃত্বকালীন ভাতার স্বপ্ন দ্রষ্টা ও অনুশীলনকারী ডরপ এর প্রতিষ্ঠাতা এএইচএম নোমানের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এই মহতি উদ্যোগের জন্য। যিনি দারিদ্র গর্ভবর্তী মা’দের নিয়ে এই মহতি চিন্তা করেছিলেন এবং নিজস্ব আত্মবিশ্বাষ ও পরীক্ষাগার হিসাবে এককভাবে ভাতা প্রদান শুরু করেছিলেন। আমাদের সরকার এখন এই পরিকল্পনাটিকে গ্রহন করে সারা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ দারিদ্র মায়েরা (বর্তমান ২০১৭-১৮ বাজেটে ৮ লক্ষ) বাড়তি পুষ্টি ও সু-স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের পক্ষ হতে ভাতা পাচ্ছেন। পুনরায় সেই মায়েরাই স্বপ্ন প্যাকেজের আওতায় টেকসইভাবে দারিদ্র বিমোচন হচ্ছেন।

প্রতিটা স্বপ্ন মা’দের আবাসন ও বাড়ির পরিবেশ খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং তাদের জীবিকায়ন ক্ষুদ্র ব্যবসা, গাভী পালন থেকে যথেষ্ট আয় করছে। পরিবারগুলো খুবই সুখি। এই সব আমার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। স্বপ্ন মায়েদের সাথে কথা বলে জানতে পারি ও উপলব্ধি করতে পারি এই প্যাকেজ পরিপূর্ন করার জন্য আর ও একটি জিনিসের অভাব রয়েছে। নিরাপদ পানির অভাব পূরনে (এসজিজি ৬) একটি টিউবওয়েল সংযুক্তি এই মহৎ উদ্দেশ্যকে আর ও কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাবে বলে আমি মনে করি। ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারনী মহলে একটি টিউবওয়েল স্বপ্ন প্যাকেজে অন্তর্ভূক্তি করার জন্য বিনীত অনুরোধ রইল। দারিদ্র মুক্ত, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে এই স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচী অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এসডিজির ১নং এজেন্ডাকে কেন্দ্র করে মাকে উন্নয়ন বটন লাইন ধরে ১৭ এজেন্ডা বাস্তবায়ন পথেই তা সম্ভব।

ফারহানা আমিন, এমএ, সমাজ কল্যাণ- ২০১৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts