আখতার-উজ-জামান ॥ অসহনীয় যানজটে জনজীবনে কষ্ট, দুর্ভোগ, ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত যানবাহন বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যস্ত নগরী ঢাকা আজ চলাফেরার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া হারে বাড়ছে যানবাহন।
জন ঘনবসতির রাজধানী ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কেই হরহামেশা দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অফিসগামী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে জরুরী হাসপাতালগামী রোগীরা পর্যন্ত।
৪০০ বছরের ঐতিহ্য ঢাকার প্রতিটি দৃষ্টিনন্দন স্থান পর্যবেক্ষণে আজ পর্যটকরা পর্যন্ত অস্বস্তি প্রকাশ করছে এই যানজটের কারণে।
২০১১-২০১২ এর একটি জরিপে পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়ার পরেই বাংলাদেশ যানজটের দেশ, তার পরে আছে ক্রমান্বয়ে ব্রাজিল, কানাডা, চায়না, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং পাকিস্তান।
বাংলাদেশের যানজট চিত্র অন্য দেশগুলোর সাথে একরকম নয়। অন্যদেশে যানজট হয় কিন্তু তার অবসানও হয় ক্রমান্বয়ে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের যানজট সহজে নিরসন হয় না। দশ থেকে পনের মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে কয়েক ঘণ্টা সময় পার করতে হয় ফলে নষ্ট হচ্ছে সময়; অপচয় হচ্ছে তেল ও গ্যাসের।
অকল্পনীয় এবং ভয়াবহ যানজটের কারণে ঢাকা শহরে মোটরচালিত যানবাহনের গতি ঘণ্টায় গড়ে পাঁচ কিলোমিটারেরও কম। আর এরই সাথে সময়ের পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে শ্রমেরর।
প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেটকারের উপস্থিতি রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ। এমনকি কিছু পরিবারের ৩/৪টি প্রাইভেটকারও পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আবার প্রায় দেখা যায় কার ড্রাইভার ও একজন যাত্রী। রোড লাইসেন্স দেয়ার সময় এই সব বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেটকার। আর সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের -বিআরটিএ হিসাবে, ২০০৮ সালের জুন থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত রাজধানীর রাস্তায় ৩৭ হাজার ৭০৫টি নতুন গাড়ি যুক্ত হয়েছে।
একটি পরিসংখ্যান মতে গত দশ বছরে শুধু রাজধানীতে যানবাহন রেড়েছে দুই লাখ বার হাজার একশ তিনটি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে কাজ করা একদল গবেষকের মতে, এই যানজটের জন্য প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে সরকারি যানবাহন অপারেটর এবং শিল্পমালিকদের গড়ে দুই হাজার করে মোট ৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আইইবির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন এই পরিসংখ্যানটি তুলে ধরেন।
ঢাকার অসহনীয় যানজট শুধু বিভিন্ন সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুই নয়, এটি একইসঙ্গে ব্যক্তিগত, স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সমস্যাও তৈরি করছে। নগরবাসী মাত্রই জানেন, তীব্র যানজটের ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা, পরিবেশবান্ধব আবহাওয়া এবং বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের ফলে কেবল ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে না, এরসঙ্গে ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।
যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি এবং সময় অপচয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দ ও বায়ুদূষণ। বিভিন্ন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা যেতে পারে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নগরবাসী। উচ্চশব্দের কারণে বিপুল সংখ্যক শিশুর শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, এমনকি অনেক শিশু বধির ও বিকলাঙ্গ হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। আর যানবাহনের বিষাক্ত কার্বন ক্ষয় করছে ওজোনস্তর। সেই সঙ্গে ঢাকাবাসী আক্রান্ত হচ্ছে হাঁপানি, যক্ষ্মাসহ নানা ধরনের রোগে।
তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে স্কুলগামী শিশু আর ট্রাফিক-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। দীর্ঘ দিন ধরে একই দায়িত্ব পালন করায় অনেকের দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। কেউ বা ভুগছেন কানে কম শোনা রোগে।
রাজধানীর পুলিশ হাসপাতালের তথ্যমতে, সেখানে যেসব রোগী (পুলিশ সদস্য) চিকিৎসার জন্য যান, তাদের ৪০ শতাংশই ভুগছেন শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে।
গতবছরের এপ্রিলে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ থেকে জানা যায়, যানবাহনের কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বস্তুকতা, সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। গত এপ্রিল মাসের পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, নগরের বাতাস স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত বেশি দূষিত হচ্ছে।
২০১২ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৫৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর প্রতিবছর ক্ষতি হচ্ছে ১৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। প্রতি ঘণ্টায় নষ্ট হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩০০ কর্মঘণ্টা।
ইউএনডিপি এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ঢাকায় যানজটে সাধারণ মানুষের যে সময় নষ্ট হয়, তা টাকার অঙ্কে ২০০ কোটিরও বেশি। একদল নগরবিদের মত, ট্রাফিক কনজেশন বা যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে আরো দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার।
ঢাকায় অতিরিক্ত যানবাহনের ফলে এর কালো ধোঁয়া বায়ু দূষিত করে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যানজটের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে ঢাকায় প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিকব্যবস্থা, অব্যাহত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, জনপরিবহন ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি অন্যতম। তবে তারা জনসংখ্যার ক্রমাগত বিষ্ফোরণকেই এক্ষেত্রে এগিয়ে রাখছেন।
১৯৯৩ সালে রাজধানীতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে লোকসংখ্যা ছিল ৭০ লাখ, আর বর্তমানে ১ কোটি ২৭ লাখে এসে ঠেকেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন উন্নয়ন পরিকল্পনার -ডিএমডিপি প্রাক্তন হিসেব অনুসারে ২০১১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪২ লাখ আট হাজার। প্রতিদিন নতুন মানুষ আসছে ২ হাজার ১৩৬ জন। নগরীতে যে হারে লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে কিন্তু আয়তন বাড়েনি। এরপরও অব্যাহতভাবে নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস ও আবাসন। আর এসব স্থাপনার বেশিরভাগেরই নেই নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা। ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাও যানজটের কারণ।
ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে একই পয়েন্টে আধঘণ্টা পর্যন্ত একদিকের যানবাহন আটকে রাখে। অনেক সময় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। সবুজ বাতির বদলে ট্রাফিক পুলিশের হাত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। মূলত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া ঢাকার রাজপথে ও ফুটপাথের বড় একটা অংশ অবৈধ দখলদারদের অধীনে রয়েছে। এই অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে পুলিশও জড়িত বলে অনেকের ধারণা। এটাও যানজটের একটা কারণ।
সরকার যানজট নিরসনে খিলগাঁও ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভার, বিজয়সরণি ফ্লাইওভার, এয়ারপোর্ট-মিরপুর ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেও যানজট লেগেই থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিক পরিবহন বা যোগাযোগ পরিকল্পনা না করে এসব উড়াল সেতু নির্মাণ শুধুই দেশের দেনা বাড়াবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন -বাপার বলছে, যে কোনো মেগাসিটিতে ফ্লাইওভার প্রকল্প যানজট নিরসনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রহণ করা হচ্ছে কি না। ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ফ্লাইওভার প্রকল্প গ্রহণ করলে তা অবশ্যই ফলপ্রসু হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার সব কটিই ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে না।
বাপা বলছে, অপরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করা এসব প্রকল্প দেখে মনে হয়, শুধু বৈদেশিক মুদ্রা খরচের জন্যই এগুলো করা হচ্ছে। যানজট নিরসনে সরকার ইতোমধ্যে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। তাই কোন অভিযোগের অযুহাত না দিয়ে পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মত হউক এটাই নগরবাসীদের দাবী।
কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে যে রাস্তা ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে ট্রেন লাইন চলাচল করছে সেটি উঠিয়ে দিয়ে বাসাবো-কদমতলা দিয়ে পাতাল রাস্তার মাধ্যমে সরাসরি বিমানবন্দর হয়ে টঙ্গি দিয়ে যদি নতুন ট্রেন লাইন করা যায় তবে ঢাকা শহরের যানজট বহুলাংশে কমে যাবে। ঢাকা শহর দিয়ে চালিত বর্তমান এই ট্রেন লাইনকে একটি বিকল্প রাস্তা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা এর উপর দিয়েই মেট্রোরেল চালু করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ বঙ্গ থেকে যে সমস্ত যানবাহন চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর সাথে চলাচল করবে সেক্ষেত্রে ঐ সমস্ত যানবাহন সরাসরি চট্টগ্রামে যাওয়া-আসার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে দিয়ে বিকল্প রাস্তা -বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা শহরের মধ্যে যে সমস্ত তৈরি পোশাক কারখানা আছে সেগুলো শহর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে শহরের উন্মুক্ত জায়গার আয়তন বাড়িয়ে ঢাকা শহরকে ক্রমান্বয়ে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ট্যানারি এলাকা শহরের মধ্যস্থল থেকে অনতিবিলম্বে অন্যত্র সরিয়ে এই সমস্ত জায়গা সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার আঙ্গিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং এই সমস্ত স্থাপনার আশপাশ দিয়ে যে সমস্ত রাস্তা আছে সেগুলো অনায়াসে প্রশস্ত করে যানজট রহিত করা সম্ভব হবে।
বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে ওভার ব্রীজ না করে অল্প খরচে পাতাল রাস্তা তৈরি করে কামরাঙ্গিরচর, জিনজিরা, কেরানীগঞ্জ এবং ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সমস্ত উপজেলার সাথে যেমন শ্রীনগর, সিরাজদিখান, দোহার এবং নবাবগঞ্জের সাথে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
এক কথায় সময় নষ্ট না করে আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদেরকে রাজধানী ঢাকাকে নতুনভাবে নতুন সাজে একটি যুগোপযোগী আধুনিক রাজধানীর প্রয়োজনীয় কাঠামো প্রদানে সচেষ্টা হতে হবে। আর এই সচেতনতার মধ্যদিয়ে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে আমাদেরকে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
ঢাকাকে যানজটের ক্ষতি থেকে বাঁচানো সময়ের দাবি। সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে, যাতে জনগণ এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পায়।
নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে এই সমস্যার সমাধান কল্পে প্রথমত সরকার যানজট সমস্যা নিরসনে দেশি ও বিদেশি সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করতে পারেন। এই কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দিতে ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিবে। দ্বিতীয়ত, প্রাইভেটকারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৃতীয়ত, অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে ফুটপাথ ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। চতুর্থত, রেল ক্রসিংগুলোতে ওভারব্রিজ তৈরি করলে যানজট অনেকাংশে নিরসন হবে। পঞ্চমত, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফ্লাইওভার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত তৈরি করতে হবে। ষষ্ঠত, গাড়ির চালককে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।