গৌরবের মাস ডিসেম্বর

শাহ মতিন টিপু  ॥ ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে গৌরবের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল বাঙালির অপরিসীম বীরত্বের অমর সংগীত। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল নতুন এক রাষ্ট্রের। বাংলার মুক্ত আকাশে উড়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় গৌরব।

জাতি যথাযোগ্য মর্যাদা ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে বিজয়ের মাস উদযাপনের লক্ষ্যে মাসব্যাপি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ থেকে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে। ছেচল্লিশ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং ত্রিশ লাখ শহীদের জীবনোৎসর্গ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ শুরু করে তার পথচলা।

বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙ্গালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক রাজনৈতিক স্বপ্ন সাধ পূরণ হয় এ মাসে।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য বাঙালিকে প্রস্তুত করে তোলেন। বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বাংলার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অপারেশন সার্চলাইট নামে বিশ্বের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা শুরু হয়। পোড়ামাটির নীলনকশা অনুযায়ী সারা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক হারে চালায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ।

বাঙালি নারীকে গণধর্ষণের মাধ্যমে তারা নতুন পাকিস্তানি গোলামের জাতি তৈরির উদ্ভট প্রক্রিয়ায় মেতে ওঠে। ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করা হয় জনসাধারণকে। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে।এদিকে মাতৃভূমি রক্ষায় বাংলার জনগণ জনযুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। সীমান্তের দিকে নামে শরণার্থীদের ঢল। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পরাজিত হতে থাকে।

কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর অপকর্ম। আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে ওঠে বাঙালির পক্ষে। গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী।ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পাকিস্তানি দখলদাররা পরাজিত হতে থাকে। মুক্ত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ঘাতক-জল্লাদরা ডিসেম্বরে মরণ আঘাত হানে বাংলায়। তারা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। তবে ঘাতক বাহিনীর শত পৈশাচিক কর্মকান্ডেও মুক্তিকামী বাঙালিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। হাজার বছরের পরাধীনতার পর বাঙালি পায় তার নিজস্ব স্বাধীন দেশ। আবার এ মাসেই জাতি হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। ডিসেম্বর তাই আমাদের গৌরবের ও বেদনার মাস।

’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেখান থেকে ৭ মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ বলে স্বাধীনতার ডাক দেন, সেখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আর জাতি অর্জন করে হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ এ বছর জাতিসংঘে শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে। এ উপলক্ষে গত ২৫ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একই স্থানে আনন্দ শোভাযাত্রাসহ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বাসস জানিয়েছে, মহান এ বিজয়ের মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচির মধ্যে আছে বিজয়ের মাসকে স্বাগত জানিয়ে সমাবেশ , মানববন্ধন, বিজয় র‌্যালি ,মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন ইত্যাদি। মাসের ১ তারিখ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলতে থাকবে।

বিজয়ের মাসের প্রথম দিনকে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস ’ হিসাবে উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে আজ সকাল ৯ টায় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতি সৌধে অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ৩ ডিসেম্বর বিজয় র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে। কর্মসূচি অনুযায়ী বিজয়র‌্যালিতে অংশ গ্রহণের জন্য এদিন সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত হবে। সেখান থেকে সকাল ১১টায় ‘বিজয় র‌্যালি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে শেষ হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিজয় দিবস উপলক্ষে সাত দিনব্যাপি কর্মসূচি গ্রহন করেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে এ কর্মসূচি শুরু হবে।

 

শাহ মতিন টিপু : সাংবাদিক, স্থায়ী সদস্য- জাতীয় প্রেস ক্লাব

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts