১০ ডিসেম্বর আব্বার অন্তর্ধান দিবস ॥ জাহিদ রেজা নূর

একাত্তর আবার ফিরে আসে ডিসেম্বর এলে। অজানা দেশের না জানি কী—আব্বা সম্পর্কে এ রকম একটা ভাবনা আসে মনে।

বয়স যখন খুব কম, তখন থেকেই জানি বাবা নেই। আব্বা চলে যাওয়ার পর একটা অসাধারণ সংগ্রাম করেছেন আম্মা। আমাদের আট ভাইকে বিপথে যেতে দেননি। শুধু বলেছিলেন, যা–ই করো না কেন, মনে রাখবে. তোমরা সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান।

ওই একটি কথাই আমাদের পথ চলতে সাহায্য করেছে।

আমরা বড় হয়েছি যখন, তখন প্রতি বছরের শেষদিকে এসে আমাদের পরনের প্যান্ট উঠে এসেছে গোড়ালির কাছে, শার্ট হয়ে গেছে আঁটোসাটো। অপেক্ষা করতাম একটি ঈদের জন্য। বছরে একবারই ঈদের সময় নতুন শার্ট আর প্যান্ট বানিয়ে দেওয়া হতো। কত কষ্ট করে যে বড় দুই ভাই সে টাকা জোগাড় করতেন!

আব্বার জন্য যেমন গর্ব হয়, গর্ব হয় আম্মার জন্যও।

আমি সেই ছেলেটিকে দেখি, যে তার মেট্রিক পরীক্ষার পড়া তৈরি করছে রাস্তার স্ট্রিটলাইটের সামনে বসে। সেই ছেলেটিকে দেখি, যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঠাট্টা করে বলছে, ‘তুমি যেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবা, সেদিন আমি গ্রামে চলে যাব হাল চাষ করতে!’

যুদ্ধের পর পাকিস্তানের জেল থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ইত্তেফাক অফিসে ফোন করে বলেছিলেন, ‘সিরাজকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে?’
কথাটা সত্যি জেনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আহা!’

Ud-1

সিরাজকে বঙ্গবন্ধু চিনতেন। ৬ দফার প্রচারণায় সিরাজের ভূমিকা জানতেন। আলোচনা করতে আসতেন ইত্তেফাকে। সিরাজ যতক্ষণ লিখত, ততক্ষণ তিনি বসে থাকতেন সামনের চেয়ারে। তারপর দুই বন্ধু কিছুক্ষণ কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু বিদায় নিতেন।

আব্বার ছিল অদ্ভুত চরিত্র। কেউ কষ্টে আছে, সেটা সহ্য করতে পারতেন না। বেতন পেয়ে সে টাকা যে কাকে কাকে দিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরতেন, নিজেও জানতেন না।

সেই অল্পকিছু টাকা হাতে নিয়ে আম্মা চালাতেন সংসার।

আমি মা–হারা সেই ছোট্ট মেয়েটিকে দেখি, যে তার জটা চুল নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। কেউ নেই ওকে একটু আদর করে। সেই মেয়েটিকে দেখি, যে কিছু বুঝতে পারার আগেই সিরাজের বউ হয়ে গুছিয়ে নিয়েছে সংসার।

নূরজাহান সিরাজী যতদিন বেঁচে ছিলেন, বুঝতেই পারিনি. কী এ ক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি আমাদের সামনে এসেছেন। অভাবের সংসারটা চালিয়েছেন হাসিমুখে। অল্প আয়োজনেই মুগ্ধ করেছেন প্রতিদিনের অতিথিদের।

অভিনেতা আল মনসুরকে খুব পছন্দ করতেন আম্মা। আল মনসুর মানে বেলাল ভাই এক সময় প্রায় প্রতিদিন আড্ডা দিয়েছেন আমাদের বাড়িতে। সঙ্গে থাকতেন হাবিবুল হাসান (মাকনা ভাই), রিয়াজ উদ্দিন বাদশা ও সাইদুল আনাম টুটুল। ঢাকা থিয়েটারের অনেক নাটকের মহড়া দেখেছি তাদের।

আসত সেলিম ভাই আর আমাদের বন্ধুরা। সারাদিন খেলতাম আমরা। বন্ধুরাও দুপুরে খেয়ে ফিরত বাড়ি। মেন্যু যা–ই হোক না কেন, তা ছিল অমৃত।

এখন আমার মনে হয়, সারাজীবন দারিদ্রের মধ্যে থেকে আম্মা সেটাই মেনে নিয়েছিলেন। দারিদ্র কাকে বলে, সে সম্পর্কে হয়তো এ কারণেই তাঁর কোনো ধারণা ছিল না।
১০ ডিসেম্বর আব্বার অন্তর্ধান দিবস। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর আম্মা মারা গেছেন।

আমাদের মাথার ওপর এখন অভিভাবক নেই। কিন্তু তারপরও মনে হয়, এনালগ যুগের একটি কালো টেলিফোন থেকে আব্বা ফোন করে বলছেন, ‘কীরে, তোরা কেমন আছিস? এই নে, তোর মায়ের সঙ্গে কথা বল।’

এ কথা মনে হলে আমি সব দুঃখ ভুলে যাই।

(এফবি থেকে)

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts