আমাদের বয়সী যেকোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি? সে অবধারিতভাবে বলবে, সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমি মনে করি, আমাদের বয়সী মানুষরা যারা সেই দিনটিতে বাংলাদেশের জন্ম হতে দেখেছি, সেই সময়ের তীব্র আনন্দটুকু পৃথিবীর খুব কম মানুষ অনুভব করেছে।
আমরা খুবই সৌভাগ্যবান একটি প্রজন্ম, যারা সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই দিনটিতে যখন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয়েছে তখন প্রথম অনুভূতিটি হচ্ছে একধরনের বিষাদ। কারণ সারা দেশে একজন মানুষও ছিল না, যার কোনো না কোনো আপনজন বা প্রিয়জন সেই যুদ্ধে মারা যায়নি। নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না, একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য একটি দেশের মানুষ কত বড় আত্মত্যাগ করেছে। বাংলাদেশের পতাকার মধ্যখানে যে লাল বৃত্ত, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে শুধু এক টুকরা লাল কাপড়, কিন্তু আমরা জানি সেই লাল রং কোথা থেকে এসেছে, আমরা জানি সেই লাল রঙে আমাদের সব আপনজনের বুকের রক্ত একটুখানি হলেও আছে।
১৯৭১ সালের বিজয়ের আগের দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের এখনো এত স্পষ্টভাবে মনে আছে যে মনে হয়, এটি মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমাদের পুরো পরিবার তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কে কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না-আমরা কিছুই জানি না। আমি যাত্রাবাড়ীতে একটা পরিবারের সঙ্গে অনেক শিশুকে নিয়ে আছি। ১৯৭১ সালের যাত্রাবাড়ী আজকের যাত্রাবাড়ীর মতো নয়, মোটামুটি ফাঁকা।
রাস্তার দুই পাশে বাড়িঘর নেই। আমি সেখানে আছি তার চারপাশে ছোট একটা জনবসতি।
তখন শেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দিনরাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। শেলিং হচ্ছে, একটি-দুটি শেল আশপাশে পড়ছে, সে রকম খবরও ভেসে আসছে। মাঝেমধ্যে এত কাছে থেকে এত তীব্র গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই যে মনে হয়, এই বুঝি সেগুলো আমাদের গায়ে এসে লাগবে। এ রকম সময়ে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা যায় না, তাই কিছু একটা করার উদ্দেশ্যে একটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ঘরের উঠানে একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলা হলো। ট্রেঞ্চের ওপরে একটা ঢেউটিনের আস্তরণ। যখন গোলাগুলির শব্দ খুব বেড়ে যায়, তখন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সেই ট্রেঞ্চের ভেতর বসে থাকি।
বাড়িটার পাশেই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারির বহর যাচ্ছে-আসছে। একদিন মিলিটারিরা সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা স্কুটারের সব যাত্রীকে মেরে ফেলল। আমরা দেখতে পাই, স্কুটারের ভেতর থেকে মৃত মানুষগুলোর হাত-পা বের হয়ে আছে। মৃত মানুষগুলো প্রকাশ্য রাস্তায় স্কুটারের ভেতর দিনের পর দিন পড়ে আছে, কেউ সেটা নিয়ে বিচলিত হচ্ছে না।
একসময় লক্ষ করলাম, রাস্তা দিয়ে বড় বড় ট্যাংক ঘড়ঘড় শব্দ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাকিস্তানি মিলিটারি! ‘পশ্চাদপসরণ’ বলে একটা শব্দ আছে, এই মিলিটারি বাহিনীকে দেখলেই বোঝা যায় তারা সেই পশ্চাদপসরণ করছে। প্রাণের ভয়ে? আমরা দূর থেকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
ঠিক তখন একদিন যখন সূর্যের আলো নিভু নিভু, অন্ধকার নেমে আসছে, গোলাগুলির শব্দ কমে আসছে, তখন নৈঃশব্দ বিদীর্ণ করে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘জয় বাংলা’।
মুহূর্তের মধ্যে আমরা বুঝে গেলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হয়েছে, যে স্বাধীনতার জন্য বুভুক্ষের মতো আমরা অপেক্ষা করছিলাম, সেই অপেক্ষার শেষ হয়েছে। সেটি জানার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল শুধু একটি স্লোগান! জয় বাংলা।
কী আশ্চর্য, মুক্তিযুদ্ধের সেই স্লোগানটি এ দেশে নির্বাসিত হয়েছিল। শুধু স্লোগানটি নয়, যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই স্লোগান সেই মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, দেশের শাসক হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতার শত্রুরা! ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে। কেউ সেই স্লোগানটি উচ্চারণ করলেই মানুষ ধরে নিত সেই মানুষটি নিশ্চিতভাবে আওয়ামী লীগের কর্মী। দেশের মানুষ মনে হয় ভুলেই গেল যে এটি কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান ছিল না। এই স্লোগানটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার আগে তাঁদের কণ্ঠ থেকে প্রকম্পিত হতো এই স্লোগান।
গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে তারা মুক্তিযুদ্ধের সেই স্লোগানটি আবার আমাদের উপহার দিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও এখন একজন শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসায় জয় বাংলা স্লোগানটি দিতে পারে!
২.
বাংলাদেশটি আমরা এমনি এমনি পাইনি। এই দেশটি পাওয়ার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। এক সময় আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। সেই পাকিস্তান দেশটির জন্য যে লাহোর প্রস্তাব ছিল, সেখানে বহুবচনে দুটি দেশের কথা বলা হয়েছিল। ‘মুদ্রণ প্রমাদ’ বলে দুটি দেশের ধারণাটিকে সরিয়ে একটি পাকিস্তান তৈরি করা হয়েছিল। আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছিলাম বলে মেনে নিয়েছিলাম, এখন নিশ্চয়ই সবাই চোখ কপালে তুলে বলে, এটি কিভাবে সম্ভব? একটি দেশের দুই টুকরা দুই জায়গায়, মধ্যখানে হাজার কিলোমিটার দূরত্ব? সেটিই ছিল আজব স্থান পাকিস্তান! জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম বেশি, অথচ সম্পদের বড় অংশ ভোগ করত পশ্চিম পাকিস্তান। পুরো দেশটিই যে ছিল ষড়যন্ত্রের জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা একটি দেশ, সেটি বুঝতে বাঙালিদের মাত্র বছরখানেক সময় লেগেছিল যখন পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিয়ে গেলেন উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হলো, রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হলো। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু আর সহনেতারা প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেন; কিন্তু বছর ঘোরার আগেই সেই সরকারকে বাতিল করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু তখন একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা, কিন্তু তাঁর বুঝতে বাকি রইল না যে পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি লাভের একটি মাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি ছয় দফার আন্দোলন শুরু করলেন।