নিয়ন মতিয়ুল
সাগর দা, আমাকে না বলেই চলে গেলেন?
সাগর দা, মানে আমাদের সাগর বসাক অর্থাৎ বগুড়া জেলা কালচারাল অফিসার সাগর দা আর নেই! সত্যি, বিশ্বাসই করতে পারছি না। দাদা চলে গেছেন গতকাল সোমবার (১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭) সন্ধ্যায়। আমি জানলাম আজ মেইল খুলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তি থেকে।
অবিশ্বাস্য! দাদা, আপনি কবে ফিরবেন?
কিশোর বেলায় ‘মৃত্যু’ ছিল আমার কাছে ভয়ঙ্কর এক দানবের নাম। মনে হতো গহীন গোপন অজ্ঞাতনামা কোনো অন্ধকার। আর আজ তাকে খুব স্বাভাবিক, অতি প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়। তবে সাগর দা’র মৃত্যু কেন যেন সেই কিশোর বেলার কথা স্মরণ করে দিচ্ছে।
সাগর দা’র সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আমার একান্ত আত্মীক সম্পর্ক। আমার ‘জীবন-মৃত্যুর’ এক সন্ধিক্ষণে পাশে পেয়েছিলাম তাকে। ঘটনাটা ২০১০ সালের দিকের। পরিশ্রমী সাংবাদিক হয়ে ওঠার সেই ‘সুক্ষণে’ তিনটা অফিসের ভয়ঙ্কর চাপ আর ব্যক্তিগত জীবনের ঘোর অমানিশার মধ্যে সাংঘাতিক বিদ্রোহী হয়ে উঠলো আমার শরীর। এক শীতের রাতে মৃত্যুর খুব নিকটবর্তী হলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকলো নাকে মুখে। মেসে তখন একা; রাতও দেড়টা পেরিয়েছে।
নিরূপায় হয়ে ফোন করলাম নাট্যকার বন্ধু সেন্টুকে। বিশেষ কারণে সে আসতে পারলো না বটে, তবে খবর দিল সাগর দা’কে। খবর পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে সাতমাথায় ছুটে এলেন সাগর দা। তখন আমার ভেজা মাথা, হাতে রক্তে ভেজা গামছা। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছি। হয়তো মৃত্যুর কোলে।
দাদা ওই অবস্থায় আমাকে জাপটে ধরে ছুটলেন মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে। সেখানে পৌঁছার পর চিকিৎসকরা জানালেন, পরিস্থিতি খারাপ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে (শজিমেক) নিতে হবে। দাদা তার প্রশাসনিক পরিচয় দিয়ে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করে ফেললেন। আমাকে নিয়ে ছুটলেন শজিমেকে। এর মধ্যেই আমার ছোট ভাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত। আমার গোটা শরীর রক্তে ভেজা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। ভেবেছে আমার আর বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই।
শজিমেকে দাদা সব ব্যবস্থা করে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করলেন। তবে কি সৌভাগ্য আমার। ঠিক ওই মুহূর্তেই পাশে এলো এক ইন্টার্ন চিকিৎসক। যে আমার এক সময়কার ছাত্র। আমাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে বললো, স্যার আমি আছি পাশে। কোনো টেনশন করবেন না। রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করছি।
সাগর দা সারারাত বসে থাকলেন হাসপাতালে, যতক্ষণ না ‘মৃত্যু’র ধাওয়া থেকে আপাত পরিত্রাণ পাই আমি। আমার ছোট ভাইয়ের তখনও ঘোর কাটেনি। আমার রক্তমাখা শরীর আর নিস্তেজ অবস্থা দেখে ও আক্রান্ত হয়েছিল ট্রমায়। ভেবেছিল ভাইকে ফিরে পাবে না। সে যাত্রায় ১৬ দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
প্রতিদিনই সাগর দা আমার কাছে আসতেন, খোঁজ নিতেন। তার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। আমার মাসহ গোটা পরিবারও তাকে স্মরণ করে অসীম কৃতজ্ঞতায়।
ফেসবুক বাদ দিলে, সাগর দা’র সঙ্গে আমার শেষ মুখোমুখি ২০১৪ সালের দিকে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীতে। দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছিল। বগুড়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতে গিয়ে কী কী বাধার মুখে পড়ছেন, কারা তার পাশে আছেন আর কারা তার বিরোধিতা করছেন- সবকিছুই বলছিলেন।
বগুড়া ছেড়ে ঢাকায় সেটেল্ড হওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন। সেগুন বাগিচায় বাসা নেয়ার বিষয়ও আলোচনা হয়েছিল। আমি উৎসাহ দিয়েছিলাম। অন্তত ঢাকায় থাকলে দু’জনের নিয়মিত দেখা হওয়ার সুযোগ থাকতো।
সাগর দা খুব মিস করবো আপনাকে। ঢাকা কিংবা বগুড়ায় আজীবন আপনাকে মিস করে যাবো। তবে সুযোগ থাকলে ফিরে আসুন!
দাদা, জানি, একদিন আমাকে আর আমাদেরও যেতে হবে ওইখানে। তবে আপনার মতো ‘হঠাৎমৃত্যু’ আর অসময়ের প্রস্থান আমাদের বর্তমানের ওপর খুব প্রভাব ফেলছে দাদা। বেদনায় নীল করে দিচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘মৃত্যু’ কবিতায় লিখেছিলেন,
‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি
বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে আমি ভালো
বাসিব নিশ্চয়’।
সত্যি ভয় নয়, মৃত্যু যেন এক ‘ভালোবাসার’ নাম। পরম বিশ্বসত্তার সঙ্গে আমার এ ‘বিচ্ছিন্ন’ সত্তার মিলনই তো ‘মৃত্যু’। তাই মৃত্যু আমাকে কলঙ্কিত করবে না। আমাকে গৌরবান্বিত করবে। আমাকে মহামিলনের স্বাদ দেবে।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন সাগর দা।
নিয়ন মতিয়ুল : সাংবাদিক
ফেসবুক থেকে