আখতার-উজ-জামান ॥ গার্মেন্টস মৃত্যুর ফাঁদ না কি শ্রমিকদের এক মুঠো অন্নের সংস্থান । নানা কারণেই প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পৌছানোর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো আজ বাংলাদেশকে গার্মেন্টস শিল্পের কর্মদক্ষতাকে বিভিন্ন উন্নয়নের সাথে এর সঠিক মূল্যায়ণ করে দেখছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই শিল্পের ভূমিকা ব্যাপক।
অথচ আমাদের এই পোশাক শিল্পে হতভাগা শ্রমিকদের এক মুঠো অন্নের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকার আশপাশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে এসে আবার চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। আর হতভাগা এই ক্ষতিগ্রস্থ পোশাক শ্রমিকদের প্রতি গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা অন্যায় করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বড় দুটি গার্মেন্টস দূর্ঘটনায় পোষাক শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে সে তুলনায় কতটুকু ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও সঠিক বিচার পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ পোষাক শ্রমিকরা!
বিশ্বব্যাপী অগ্নিকাণ্ডের সমীকরণে ১৯১১ সালের পর পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তালিকায় উঠে আসে ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড। সরকারী হিসেব মতে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা ১১১ জন ও শত শত শ্রমিক আহত হন সে সময়।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে সাভার ট্রাজেডি। যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দূর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত ইতিহাস সৃষ্টিকারী রানা প্লাজা ধ্বস। যেখানে ছিল মৃতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। ঐ ধ্বসে সরকারি হিসাবে ১,১২৭ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। আহত হয়েছে প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক।
কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা ও নিহতের সংখ্যার পরিসংখ্যান গড়মিল দেখা যায়। এতে সরকার, বিজিএমইএ এবং মালিক পক্ষকে সন্দেহের চোখে দেখেছে অনেকেই। ধরে নেয়া হয়েছে পরিসংখ্যানের প্রকৃত সংখ্যাটি ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার দূর্ঘটনাগুলো এখনও পর্যন্ত কেবল মৃত শ্রমিকের সারিই বড় করছে।
একটি সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে ১৯৯০ থেকে ২০১৩ ইং সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে গার্মেন্টস শিল্পে বিভিন্ন দূর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২১২৯ জন।
১৯৯০ ঢাকার সারাকা গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৩২ জন নিহত হয়, যার মধ্যে ২৫ জনই ছিল নারী ও শিশু। ১৯৯১ সালে গার্মেন্টস কারখানা দূর্ঘটনায় মারা যায় ৫ জন। ১৯৯৩ এ নিহতের সংখ্যা ১২ জন। ১৯৯৪ এ নিহত হয় ৫ জন। ১৯৯৫ মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় ৯টি লাশ। ১৯৯৬ এ ঢাকাস্থ লুসাকা গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২২ জন। ১৯৯৭ এ নারায়নগঞ্জের জাহানারা ফ্যাশন ফ্যাক্টরীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ২০ জন এবং ঢাকাস্থ সাংহাই অ্যাপারান্সে অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২৪ জন।
২০০০ সালে ঢাকার ম্যাক্রো সোয়েটারে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ২৪ জন। কারখানাটিতে একই বছরে মোট তিনবার দূর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে রাজধানীর গ্লোব নিটিং এ মারা যায় ১২ জন এবং চৌধুরী নিটওয়্যারে ৫১ জন। ২০০৪ মিরপুরের একটি পোষাক কারখানায় ট্রান্সফরমার বিস্ফোরনের শব্দে হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে মারা যায় ৭ জন নারী শ্রমিক। নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যারে দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২৩ জনের।
২০০৫ এ নারায়নগঞ্জের শান নিটিংয়ে দূর্ঘটনায় মারা যায় ২৩ জন। স্পেকট্রাম ভবন ধ্বসে মৃত্যু হয় ৮০ জন শ্রমিকের। ২০০৬ সালে গাজীপুরের যমুনা টেক্সটাইল মিলে অগ্নিকাণ্ডে ৬ জনের মৃত্যু হয় এবং চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পজিটে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে মারা যায় ৬২ জন। এছাড়া সায়েম ফ্যাশনে দূর্ঘটনায় আরো ৩ জন মারা যায়।
২০১০ এ গাজীপুরের গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায় ২৫ জন। ভুল অগ্নি সংকেতের কারণে হুড়োহুড়িতে গাজীপুরের ম্যাট্রিক্স সোয়েটারসে মারা যায় ১জন এবং ঢাকাস্থ গ্র“পের স্পোর্টসওয়্যার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে মারা যায় ২৪ জন। ২০১৩ সালে স্মার্ট এক্সপোর্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ৭ জন।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের দেয়া তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ২১৩ টি কারখানা দূর্ঘটনায় ৪১৪ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মুত্য হয়। তবে ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২১৪ টির মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যাতে ৭০০ শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এমন তথ্য গার্মেন্টস মালিক সংগঠন বিজিএমইএ এবং অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর দেয়া পরিসংখ্যান বলে পত্রিকা সূত্র দাবি করে।
আর বড় দুই দুর্ঘটনার জন্য বরাবরই পোষাক কারখানার মালিক সহ বিজিএমইএ’র কর্মকর্তাদের দায়ী করে শ্রমিক শ্রেণি থেকে দাবি তোলা হয়েছে ঐ সব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে দেশে বিদ্যামান বিশেষ দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ অনুসরণ করে নিহত, নিখোঁজ ও আহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ, নিহত শ্রমিকদের এক জীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ জন্য।
এছাড়াও তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের পর দাবিতে উঠে আসে গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নি প্রতিরোধ ও মোকাবেলা তদারকির জন্য স্বাধীন পরিদর্শক কমিটি গঠন ও যে সকল গার্মেন্টস কারখানায় বিকল্প সিঁড়ি নেই সে সকল কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা।
অন্যদিকে, রানা প্লাজা ধ্বসের পর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা পড়ে রাষ্ট্রভান্ডারে অপর্যাপ্ত উদ্ধারক যন্ত্রপাতি! বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলোতে দূর্ঘটনা এড়াতে সহায়ক ও দূর্ঘটনা পরবর্তি উদ্ধারকরার যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন । তেমন কোন ভারি যন্ত্র থাকায় হারাতে হয়েছে অনেকগুলো তাজা প্রাণ। এটাই সত্যি; কেউ নেবে না এই প্রাণঘাতের দায়! তবে এর থেকে নতুন যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে করে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি স্বরূপ পরিমাণ মত উদ্ধারক যন্ত্রপাতি মজুদ করা সরকারের একান্তই প্রয়োজন।
শ্রমিক নিরাপত্তা ও বিভিন্ন ইস্যু দাঁড় করিয়ে যেমনি ইউরোপ-আমেরিকা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ঠিক একই ভাবে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক শ্রমিক পোষাক শিল্প থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ন্যায্য মজুরীর ও নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য দেখা দিচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। রাস্তায় নেমে আসছে শ্রমিকরা। আবার দূর্ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকদের সঠিক ভাবে মূল্যায়ন না পাওয়ায় তথা সঠিক বিচার না পাওয়ায় এই শিল্প থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই। নতুন করে যোগদানে নেই তেমন উৎসাহ।
বিশেষ করে রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর পোষাক শ্রমিকদের মধ্যে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে এতেই অনেকেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পেশা পরির্বতনের যা রীতিমত উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি অশুভ বার্তা। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার, বিজিএমইএ ও মালিক পক্ষে এক যোগে কাজ করতে হবে। নতুবা শ্রমিকরা যেমন ভাগ্য নির্ধারণে অন্য পেশা গ্রহণ করবে।
পরিশেষে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বজায় রাখতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দেশের তেরি পোশাক খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের আরো উন্নয়নকে গতিশীল করতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় গার্মেন্টস পল্লীর নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারি প্রয়াসের সহযোগিতা দেয়ার জন্য পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতি আবারও আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি গার্মেন্টস পল্লী প্রতিষ্ঠার জন্য গ্যাস সরবরাহ থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবেন বলেও জানিয়েছেন। এটা অত্যন্ত শুভ সংবাদ।
এই শুভ সংবাদের রেশ ধরে দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে আরও সহানুভূতিসহকারে এই গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের সকল দাবি-দাওয়ার পূরণেরও আহবান জানাই।