বাবুল আহমেদ পারভেজ
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী হিসাবে এটা হবে তাঁর ১২তম বাজেট উপস্থাপনা। এর মধ্য দিয়ে টানা ১০ম বাজেট উপস্থাপনের নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন তিনি। এই উপমহাদেশেতো অবশ্যই, বিশ্বের আর কোন দেশে এমন নজির নেই। একটি দেশের জাতীয় বাজেট পেশের এমন দৃষ্টান্তে ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আজ এই মহান মানুষটির ৮৫তম জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যার কর্মস্পৃহা বলে দেয় তারুণ্যদীপ্ত তিনি। যার আচরণ বলে দেয় বয়স তাঁর মনকে ছুঁতে পারেনি, তিনি এখনও চিরসবুজ। ক্লান্তি পরাজিত যার বিরামহীন কর্মতৎপরতার কাছে।
১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশের পর এ পর্যন্ত মোট ১১ জন অর্থমন্ত্রী ৪৫টি বাজেট পেশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সিলেটের প্রয়াত সাইফুর রহমান, প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত মিলে মোট ২৮ বার বাজেট পেশ করেছেন। আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে তার দেওয়া বাজেটের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২টি। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম.সাইফুর রহমান তিন দফায় ১২টি বাজেট দিয়েছিলেন। জনাব মুহিত সে সংখ্যাটিও ছুঁয়ে ফেলবেন এবার। অর্থমন্ত্রী মুহিত ২০১০-২০১১ অর্থবছরে একলাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষা-সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা একাধারে অনেক অর্জনের অধিকারী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর জন্ম সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি এ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
গতবছর ৮৪তম জন্মদিনে সচিবালয়ে মিডিয়ার পক্ষ থেকে তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভূতপূর্ব অনুভূতি। যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় আমি এখনো কর্মক্ষম আছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে। আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ দেখতে চাই। সারা জীবন এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কাজ করেছি।’ আর এটাই হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য- মনে চির তারুণ্য এবং বুকে দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা। তার শুধু একটাই কথা ‘কাজ আর কাজ’। যা তিনি আজও নিজের জীবনে প্রমাণ করে চলেছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কর্মস্পৃহা অনেকবারই মুগ্ধতা অর্জন করেছে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে বলেছেন সবার মধ্যে তরুণ। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। কখনো বেখেয়ালে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে ফেলেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার দৈনিক কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার দৈনিক কর্মসূচিতে কিছু সময় আমি চিন্তা করে রাখি কীভাবে ব্যবহার হবে। সেখানে অফিসের কাজও অন্তর্ভুক্ত করি। অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সেটাও অন্তর্ভুক্ত করি। কারণ সেখানেও কিছু কাজ হয়। এভাবে যদি অফিসের কাজের হিসাব করি তাহলে কোনো দিন ১২ ঘণ্টার কম হয় না। ১২ ঘণ্টা হলো মিনিমাম, ১৬ ঘণ্টা হলো সহনীয়।’
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের লেখা আগামী প্রকাশনীর ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ গ্রন্থে আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার বিশালতার কথা জানতে পারা যায়। দেখা যায় তিনি যুগান্তকারী পাঁচটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শেষযুগে ভারতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন অবলোকন করেছেন উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়, একজন সহকারী আমলা হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ঊনসত্তরের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন। একজন পদস্থ আমলা হিসেবে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে এসে পাকিস্তানের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জ্ঞাত হয়েছেন, যা এ গ্রন্থে বিধৃত করেছেন তিনি।
ওয়াশিংটন দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সমিতির সম্পাদক থাকাবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সপক্ষে বিভিন্ন জন ও সংস্থার সক্রিয়তা, জাতিসংঘ শরণার্থী হাই কমিশনে জড়িত থাকা ও মুক্তিযুদ্ধের আটমাস একজন কংগ্রেসনেল লবিস্ট থাকাবস্থায় তাঁর অভিজ্ঞতা, প্রাদেশিক রাজধানীতে স্বরাষ্ট্র বিভাগে ও করাচীতে পরিকল্পনা কমিশনে চাকরীরত অবস্থার অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। মুজিবনগর সরকারের জন্য সংবাদ প্রেরণে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও অর্থযোগান বিষয়ে নেপথ্য কর্মকান্ড বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ওয়াশিংটন বাঙালি সমিতির উদ্যোগ, আমেরিকায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঞ্চয়ন, ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারের কার্যকলাপও লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকার, জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীর ভূমিকা, আমেরিকার পত্রপত্রিকার ভাষ্য, বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ, দাতাগোষ্ঠী ও জাতিসংঘের ভূমিকা এসবও আলোচনা করেছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের আলোকে বলা যায়, এক বিশাল অভিজ্ঞতার মহীরুহ হিসাবে তিনি আমাদের মাঝে সপ্রতিভ হয়ে আছেন।
জনাব মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ(অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
তাঁর চেতনার গভীরে প্রোথিত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। তাঁর ভাষ্যে, ‘বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ আমার কাছে প্রতিশব্দ। কারণ, বাংলাদেশের চিন্তা আমরা কখনো করতে পারি না, যখন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা আমরা করি না। ঠিক তেমনি যখন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা আমরা করি, তখন বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে।’
তাঁর কথায়, ‘ক্ষমতার সীমিত সময়ে দেশের বড় উন্নয়ন করেছেন বঙ্গবন্ধু। খুব কম দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন; কিন্তু একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে ফান্ডামেন্টাল স্টেপসগুলো দরকার, তা তিনি মাত্র তিন বছরের মধ্যে করে গেছেন।’
ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে জড়ানো মুহিত পরে পাকিস্তান আমলেই সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল তার। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। আর প্রবাসী বাংলাদেশি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর মুহিত পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮১ সালে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান তিনি। ১৯৮২ থেকে ৮৩ সালে এরশাদ সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান মুহিত। এরপর বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চপদে চাকরি করেন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে বিএনপি নেতা এম সাইফুর রহমানকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকেই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। দেশের বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য তিনি, সততায়-সচ্ছতায় দৃষ্টান্ত, প্রধানমন্ত্রীর পরই তার অবস্থান। তারমাঝে রাখঢাক বলতে কিছু নেই। নিজে স্পষ্ট কথা বলেন, স্পষ্ট কথা শুনতে পছন্দ করেন। সুদীর্ঘ মন্ত্রীত্বের জীবনে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যা তার ব্যাক্তিত্বকে সামান্যতম ম্লান করতে পারে।
একজন মানুষের যে কত প্রতিভা থাকতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ মুহিত। একাধারে তিনি রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, রবীন্দ্র গবেষক, ইতিহাসবিদ ও ভাষাসংগ্রামী। রাজনীতিক হিসেবে তিনি যেমন অভিজ্ঞ, আবার ব্যাক্তিজীবনেও অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ। ইতিহাসের প্রতি ঝোঁক তার প্রবল। ইতিহাসচর্চা করছেন আজীবন। তার রচিত ৬০টিরও বেশি বইয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি ইতিহাসের। তার ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’ পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
কৈশোরে প্রগতিশীল মনের এই ব্যক্তিত্ব জীবনের এ পর্যায়ে এসেও প্রগতিশীল ভাবনায় চিরসবুজ। মানসিকভাবে একেবারেই অসাম্প্রদায়িক ও উদার। তার বঙ্গবন্ধু ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি অটুট বিশ্বাস। সর্বোচ্চ ভালোবাসা তার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি।
স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতে বিশেষজ্ঞ, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।
শুভ জন্মদিনে তাকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি শতবর্ষ পেরিয়েও আমাদের মাঝে সরব থাকুন- এটাই প্রার্থনা।
বাবুল আহমেদ পারভেজ: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সমন্বিত উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। bbskp71@yahoo.com