এক.
তারুণ্য হচ্ছে একটা দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আবার যদি বলি, তারুণ্য শুধুমাত্র দেশের নয় গোটা বিশে^র সম্পদ তাও অমূলক নয়। বরং বিশ^ বিবেচনায়, তারুণ্যের বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা দেশ কিংবা গোটা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে তারুণ্য। তারুণ্যের মধ্যেই স্বপ্ন সৌন্দর্যের বিজ থাকে লুকানো। এই স্বপ্ন সৌন্দর্যের বিজ অংকুরিত হয়ে একদিন ভবিষ্যতের পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষ হয়। এই পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষ পরিবারকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়, ফুল, ফল ও ফসল দেয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এই পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষের মাধ্যমে হৃষ্ট হয় পুষ্ট হয় এবং উন্নতির সোপানে আরোহণ করে। তাই সবার লক্ষ থাকে তারুণ্যের দিকে এবং অমূল্য সম্পদ এই তারুণ্যকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র লালন করে পালন করে। রাষ্ট্র তার তারুণ্যের শারীরিক শক্তি, মেধা শক্তি বিকাশের জন্যে সবকিছুই করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার জন্যে রাষ্ট্র নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে। পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও যাতে তারুণ্য এগিয়ে যেতে পারে সে লক্ষে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করে। অন্যদিকে পরিবার ও সমাজ তার তারুণ্যকে সঠিকভাবে পরিচালিত হবার দিক নির্দেশনা দেয়। মূলত যৌথ ভূমিকার মধ্যদিয়ে তারুণ্য ভবিষ্যতের পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষে পরিণত হয়।
যে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এই পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষের সংখ্যা যতবেশি সেখানে ততবেশি সমৃদ্ধির আনন্দ সুখের বাতাস বয়ে যায়। এখানে তারুণ্য হচ্ছে পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষের প্রাথমিক পর্যায় বা বৃক্ষ চারা। তাই তারুণ্যকে পরিচর্যার বিষয়টি জরুরী। না, শুধু জরুরী নয়, অতি জরুরী।
দুই.
বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিভিন্ন পেশার মানুষ, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ বাস করে। কিন্তু প্রত্যেকেই তার দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, জনগনের প্রতি কল্যাণের দৃষ্টি নিবেদিত রাখে। এক কথায়, দেশ ও মাটির প্রতি পরম মমতায় তারা একতাবদ্ধ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি তা কিন্তু সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার ফসল বা প্রাপ্তি। যেখানে পাক বাহিনির বিরুদ্ধে নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল সাত কোটি বাঙালি, যার অগ্রভাগে ছিল এই দেশের এই সমাজের এই পরিবারের অমূল্য সম্পদ তারুণ্য এবং পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষ। নয় মাসের এই মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝরে গিয়েছিল অসংখ্য তরুণ প্রাণ, ঝরে গিয়েছিল অসংখ্য পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষ। মূলত তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই কিন্তু জন্ম লাভ করেছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে তরুণেরা সরসরি অবতীর্ণ হয়েছিল সৈনিকের ভূমিকায়। পুষ্পিত বৃক্ষরা ছিল অনুপ্রেরণায়, নের্তৃত্বে ও দিক নির্দেশনায়।
তিন.
কিন্তু আজ পরিবার, সমাজ ও দেশের ভবিষ্যত সোনালি চাবি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের প্রতি শকুনের দৃষ্টি পড়েছে। শকুন মানে অশুভ শক্তি। এই অশুভ শক্তি দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু, পরিবারের শত্রু। এই অশুভ শক্তির কাছে বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমির মাটি। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে মমতাময়ী মায়ের কোমল বুক। হাহাকার করে উঠছে দেশ প্রেমিক বাঙালির হৃদয়। এই অশুভ শক্তি আমাদের প্রাণ প্রিয় তরুণদেরকে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ট সৃষ্টি নিরপরাধ মানব হত্যায় জড়িত করছে। নেশা গ্রস্থ যুবক যেভাবে তার নিজের বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলে তেমনি তরুণদেরকে মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর করে অশুভ শক্তি তাদের অশুভ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। আর বলি হচ্ছে, তরুণরা। এই অশুভ শক্তি লক্ষ লক্ষ চক্ষুর আড়ালে গোপনে তরুণদেরকে মানব হত্যার উদ্ধুদ করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানব হত্যার মন্ত্রপাঠ শেখাচ্ছে।
চার.
অশুভ শক্তি আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। অশুভ শক্তির ছায়া কোন তরুণের উপর কখন পড়বে আমরা কেউ জানিনা। এমন একটা সময়ে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি যে, কার গৃহে কখন আগুন লাগবে আর কোন সমাজ জলে পুড়ে ছাই হবে কেউ তা জানি না বা কেউ জানে না। তবে ইতোমধ্যে এই অশুভ শক্তির অশুভ কর্মকান্ডের ঘটনায় প্রিয় মাতৃভূমি ছারখার হয়েছে বেশ কয়েকবার। এখন আমরা প্রতিনিয়ত আতংকিত সময় পার করছি। দিন ও রাত সমান হয়ে গেছে। চলতে ফিরতে মনের আঙ্গিনায় এক ধরণের ভয় কাজ করে। এই বুঝি অশুভ শক্তি তার দানব চেহারা নিয়ে সম্মুখে এসে দাঁড়াবে। স্বাধীন দেশে মুক্ত পাখির মতো না উড়ে বরং পরাধীনতার শেকল পায়ে যেন পথ হাঁটছি।
পাঁচ.
এই অশুভ শক্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সবাইকে সতর্ক পায়ে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাইকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণরা যাতে লাইনচ্যুত না হয়, সে জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখাপড়ার বাগানে, খেলাধুলার বাগানে, মসজিদে-মন্দিরে যাতে আর একটাও বিষধর সাপ প্রবেশ করতে না পারে এ জন্য ঘরে বাইরে সব জায়গায় সব সময় আলোর মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে। যারা আমাদের পুষ্পিত বৃক্ষ তাদেরকে এই মশাল জ¦ালিয়ে আলোকিত করে রাখতে হবে চারপাশ যে আলোর মশাল থেকে তরুণ শিক্ষার্থীরা পাঠ নেবে মানবতার, পাঠ নেবে স্বদেশ ভালোবাসার, পাঠ নেবে হৃদয় নান্দনিকতার, পাঠ নেবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার। এক কথায় সে পাঠ নেবে জীবন সৌন্দর্য বোধের। মনে করি, তখনই তরুণরা দেশের প্রকৃত সম্পদে পরিণত হবে। পরিণত হবে পুষ্পিত সোনালি বৃক্ষে। আর অশুভ শক্তি কোথাও ঠাঁই না পেয়ে বানের জলের ¯্রােতের মতো নর্দমায় পতিত হবে।
শিউল মনজুর : কবি ও কথাসাহিত্যিক।
sheoulmanjur@yahoo.com