শাহ মতিন টিপু
এ দেশের শহুরে, শিক্ষিত, বিত্তবান, চাকরিজীবী নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু যারা সুবিধাবঞ্চিত স্ব-কর্মসংস্থানে জীবনযাপন করেন, ছুটি চাওয়ার কোনো স্থান নেই, দরখাস্ত প্রেরণের কোনো জায়গা নেই, গরিব, দুঃস্থ, নদীভাঙা, গৃহহীন, খোলা আকাশের নিচে যাদের বসবাস, শহরের বড় বড় সড়ক অলি-গলিতে রোজ আনে রোজ খায়, স্বামীর বাড়িতে নির্যাতন, বাপের বাড়িতে অগ্রহণীয়, মর্যাদাহীন জীবন অতিবাহিত করেন—এমন মায়েদের জন্য সরাসরি মাতৃত্বকালীন ভাতা অর্থাত্ গর্ভকাল ও বুকের দুধ পানের সময়সহ মোট ২৪ মাস বা দুই বছর নগদ ভাতা প্রদান জরুরি বলে উপলব্ধিতে একজন মাতৃবন্ধু। তার নাম এএইচএম নোমান। মা এবং মানুষ—এই দুটি শব্দের বৃত্তে যিনি জীবনের দীর্ঘসময় অবিচল থেকেছেন। যাকে বলা হয় ‘মা’বান্ধব। মাতৃত্বকালীন ভাতার দাবি প্রতিষ্ঠায় যিনি অগ্রগণ্য ব্যক্তি হিসাবে আজ পরিতৃৃপ্ত, যার মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মণ্ডলেও স্বীকৃত, সে এএইচএম নোমান আজ ৭১ বছরে পা রাখলেন। কর্মজীবনের শুরু থেকেই যিনি কাজ করেছেন দরিদ্র ও ছিন্নমূল মায়েদের জন্য। তার ভাবনায়—প্রজনন স্বীকৃতি পেলে, ধনী-গরিব বিভেদ ও বৈষম্যের অবসান হলে গর্বিত মা ও সুস্থ শিশুর জন্ম অধিকার রক্ষা হবে। এতে ভবিষ্যতে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথ রচনা হবে—এই লক্ষ্য নিয়েই সামর্থ্য অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচির যাত্রা শুরু করেন তিনি। তার সেদিনের সেই ছোট্ট প্রচেষ্টাটি আজ সফল।
২০০৫ সালে বিশ্ব মা দিবস উদ্যাপনকালে নোমান নিজের পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ‘ডর্প’—এর মাধ্যমে মাত্র ১০০ জন অতিদরিদ্র মাকে চিহ্নিত করে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেন। এটি ছিল তার নতুন উদ্ভাবন ও প্রথম উদ্যোগ। সেদিন দরিদ্র মায়েদের ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ প্রদান ছিল এক নতুন ইতিহাস। সোনালি হরফে লিখে রাখার মতো বর্ণিল উদ্যোগ। সাহস করে এএইচএম নোমান ঘোষণা করেছিলেন, মাতৃত্বকালীন ভাতা দানের কর্মসূচি। জনাব নোমান বলেন, আমার বিশ্বাস, এই উদ্যোগটি আমার জন্য আল্লাহপাকের এক অনন্য অবদান। আমি নদীভাঙা এলাকার লোক বলেই হয়ত আমার মনে অসহায় গরিব-দুঃখী মায়েদের কষ্ট কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছি।
এ এইচ এম নোমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশের দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কার্যক্রম চালু করে। শুরুতেই দেশের ৩ হাজার ইউনিয়নে ৪৫ হাজার মাকে এই ভাতা দান করা হলেও বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার সারা দেশে মাসে ৫০০ টাকা করে বছরে প্রায় ৫ লাখ মাকে এই ভাতা প্রদান করছে। মায়ের গর্ভে বাচ্চা আসা থেকে শুরু করে বুকের দুধ খাওয়া পর্যন্ত ২৪ মাস পরিকল্পিত পরিবার গঠনে মা শুধু এই ভাতা পাচ্ছে। এতে বাল্যবিবাহ, তালাক ও যৌতুক রোধ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জন্ম নিবন্ধন উত্সাহিত হচ্ছে। সরকারের মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই ভাতাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
১৯৭০-এ ‘ধ্বংস থেকে সৃষ্টির’ প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে এখন পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৫ বছর এই সেবাকাজেই আছেন। মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচির উদ্ভাবক হওয়ায় তিনি ইতিমধ্যে ‘মাতৃবন্ধু’ খেতাব পেয়েছেন। মাতৃত্বকালীন ভাতা বাস্তবায়নের পর পুনরায় মায়েদেরকে কেন্দ্র করে তিনি দারিদ্র্যমোচনের জন্য শুরু করেন স্বপ্ন প্যাকেজ নামে আরেকটি সমৃদ্ধ কার্যক্রম। ‘স্বপ্ন’ প্যাকেজ কার্যক্রমটি মাতৃত্বকালীন ভাতাপ্রাপ্ত মা-বাবা-শিশুকেন্দ্রিক ৫ ভিত্তি সম্বলিত সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কার্যক্রম। দিনবদলের জন্য ৫টি স্বপ্নের প্যাকেজ বাস্তবায়ন হলে সমাজে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো বৈষম্য থাকবে না। গড়ে উঠবে চমত্কার সামাজিক বন্ধন। স্বপ্ন প্যাকেজে রয়েছে—১. স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্ড; ২. শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড; ৩. স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ একটি ঘর; ৪. জীবিকায়ন সরঞ্জাম; ৫. সঞ্চয়, বনায়ন ও প্রয়োজনে উন্নয়ন ঋণ।
‘স্বপ্ন’ প্যাকেজ কর্মসূচিটিও এখন সরকারিভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ কর্মসূচি সরকারিভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য জনাব এএইচএম নোমান প্রায় চারটি বছর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লবি, অ্যাডভোকেসি করেন। জনাব নোমান সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, এ কর্মসূচিটি দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখবে। তার দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে সরকার প্রায় এক হাজার মায়ের দারিদ্র্য বিমোচনে ২০১৪-১৬ দুই অর্থ বছরে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করে। স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচির স্বপ্নদ্রষ্টা নোমান বলেন, ‘দিন বদলের সনদ’-স্লোগান, সরকারের কাছে নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন অনেক। এই ‘স্বপ্ন’ বাস্তবায়নে মাতৃত্বকালীন ভাতাপ্রাপ্ত গরিব মা-বাবা-শিশুকেন্দ্রিক পরিবার উন্নয়নই দারিদ্র্যমোচনের মূল চাবিকাঠি। ভাতাপ্রাপ্ত মা শিশুকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন করলে আগামী প্রজন্ম অর্থাত্ ২০ বছর মেয়াদে কমবেশি ১ কোটি মা কাভার করলে দেশে দরিদ্র পরিবার থাকবে না। বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ ও সুখী সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে।
দেশের মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজপ্রাপ্ত মায়েরা জনাব নোমানকে নিজেদের পরম বন্ধু ভাবছেন। তারা অকপটে বলছেন, মানুষটি সত্যিই মায়েদের বন্ধু। নোমানের মতো তারাও আলোকিত সন্তান জন্ম দিতে চান, যারা নোমানের অবর্তমানে হাজারো নোমান হয়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রতিটি মায়ের জন্য বন্ধু হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়াবে। মায়েদের বিভিন্ন ধরনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কাজ করবে।
আমাদের দেশের অনেক গুণীজন ছিলেন যারা জীবিত থাকতে সরকারিভাবে মূল্যায়ন পাননি। বড় মানুষেরা কখনো মূল্যায়ন বা পদক পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করেন না। তারা নৈতিকতাবোধ থেকেই শুভ কাজগুলো সম্পন্ন করেন। নোমান মায়েদের নিয়ে কাজ করে পৌঁছে গেছেন বিশ্বদরবারে। দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবহিতৈষী কাজে অবদান রাখার জন্য তিনি ‘গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার-২০১৩’ লাভ করেন। বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেন।
এএইচএম নোমান ১৯৪৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভোলার দৌলতখানের তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানা সদর আলেকজান্ডারস্থ শিক্ষা গ্রামে তার বাড়ি। বাবা বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও চিকিত্সক আলহাজ ডা. মফিজুর রহমান (মৃত)। দরদী মনের ধর্মপ্রাণ মা শামছুননাহার (মৃত)। তিনি জগন্নাথ কলেজ থেকে বি.কম. পাস (১৯৬৬) করেন। জগন্নাথ কলেজে (৬৪-৬৬) বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এসআর হল শাখার সভাপতি এবং ঢাকা শহর ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। সিএ ফার্ম এ কাশেম অ্যান্ড কোম্পানি থেকে সিএ কোর্স সমাপ্ত করেন (১৯৭০)। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টন্স স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির আহবায়ক ছিলেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকলেও কর্মজীবনে মাঠ পর্যায়ের মানুষের সেবায় ডুবে যান এবং এখানেই খুঁজে ফেরেন জীবনের আস্বাদ। দরিদ্র মায়েদের সেবার মানসেই আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন, তার ৭১তম জন্মদিনে এটাই প্রার্থনা।
লেখক :সাংবাদিক ও গবেষক