সুভাষকে নিয়ে যা ঘটেছে যা রটেছে

দীপংকর মুখোপাধ্যায় কালের নিয়মে ২৩ জানুয়ারি প্রতি বছরই আসে, সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের ওডিষা রাজ্যের কটকে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ছিলেন আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম।

১৯৪৫-এর ২৩ অগস্ট জাপানি সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রচার করে যে পাঁচ দিন আগে, অর্থাত্, ১৮ তারিখে নেতাজি তাইহোকু দ্বীপে (বর্তমান তাইপে) এক বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন, তাঁকে জাপানে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

পরে জানা যায় যে নেতাজির ঘনিষ্ঠ পার্ষদ এবং আজাদ হিন্দ সরকারের তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী এস এ আয়ার টোকিওতে বসে, জাপানি সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে (বা নির্দেশে) খবরটির খসড়া করে দেন। আয়ার পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলের ধারেকাছেও ছিলেন না বা নেতাজির মৃতদেহ চোখেও দেখেননি। পরে ধীরে ধীরে সংশোধনী আসতে শুরু করে যে মৃত্যু এবং সত্কার, দুটিই তাইহোকুতে সম্পন্ন হয়, কেবল চিতাভস্ম টোকিওর একটি বুদ্ধমন্দিরে রাখা হয়েছিল।

খবরে ভারতে শোকের ঝড় উঠল বটে, কিন্তু অচিরেই লোকে সন্দিগ্ধ হতে শুরু করল। অবিশ্বাসীদের তালিকায় বড়লাট লর্ড ওয়াভেল থেকে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, সকলেই ছিলেন। সরকার একটি শক্তিশালী, উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা দলকে এই ঘটনার তদন্ত করতে দিলেন, সে দলে ইংরেজ, মার্কিন, ভারতীয়— যাবতীয় গোয়েন্দা ছিলেন।

এঁরা জাপান ও তাইহোকুতে অনুসন্ধান চালালেন, যে ডাক্তার নেতাজির চিকিত্সা করার দাবি করতেন, তাঁকেও জেরা করেন, কিন্তু কোনও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি. কেননা, অক্টোবর মাসে সুভাষ বসুকে নিয়ে কী করা যায় তা নিয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা দীর্ঘ আলোচনা করে। বিচার, জেল বা ফাঁসির দাবি না তুলে ভারত সরকার সুপারিশ করেছিল তিনি যেখানে আছেন, তাঁকে সেখানেই থাকতে দেওয়া হোক। এই সুপারিশ থেকে তাঁর বিদেশে আত্মগোপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এই অনুসন্ধানের মধ্যেই মিত্রশক্তির গোয়েন্দারা নেতাজির একান্ত বিশ্বাসভাজন, আজাদ হিন্দ ফৌজের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ কর্নেল হবিবুর রহমানের দেখা পান. হবিবুর জানান, তিনি নেতাজির শেষযাত্রার সঙ্গী ছিলেন। দুর্ঘটনা, মৃত্যু, সত্কার— তাঁর সর্বাধিনায়কের অন্তিম পরিণামের আঁখো দেখা হাল তিনি গোয়েন্দাদের শুনিয়ে দেন। হবিবুরের বৃত্তান্ত সম্বন্ধে কেউ কেউ সন্দিহান হলেও তাঁর বয়ানই শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়। পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে হবিবুর গাঁধীজি ও বসু পরিবারকেও তাঁর কাহিনি শুনিয়ে তাঁদের বিশ্বাস উত্পাদন করেন। দেশবিভাগের পরে অবশ্য তিনি পাকিস্তান চলে গিয়ে সেখানকার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৪৬ সালেই জনৈক কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক হারীন শাহ তাইহোকু গিয়ে নিজের উদ্যোগে কিছু অনুসন্ধান চালান। তিনি হবিবুর কথিত হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলেন যাঁরা নেতাজির শেষশয্যার পাশে উপস্থিত ছিলেন। তার পর তিনি নগরপালিকা থেকে নেতাজির সত্কারের সার্টিফিকেটের নকলও সংগ্রহ করেন। দেশে ফিরে যাবতীয় তথ্য তিনি কংগ্রেসের শীর্ষনেতাদের হাতে তুলে দেন এবং তাঁরাও নেতাজির মৃত্যু সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়ে যান। স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বার বার জোর গলায় এই দাবি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন।
সুভাষচন্দ্রের দুর্ভাগ্য, বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষ থেকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করার লোক সে সময় খুব বেশি ছিল না। কংগ্রেসে তিনি দীর্ঘ দিন অপাংক্তেয়, তাঁর মেজদা শরত্চন্দ্রও দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কমিউনিস্টরা তাঁকে তোজোর কুকুর বলে ব্যঙ্গ করতেন, দক্ষিণপন্থী শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গেও তাঁর প্রীতির সম্পর্ক ছিল না। তা ছাড়া, চিরকৌমার্য্যে দীক্ষিত সুভাষচন্দ্রের গোপনে নিজের বিদেশিনী সেক্রেটারিকে বিবাহ করে কন্যার পিতা হওয়া রক্ষণশীল বসু পরিবারের সকলের পক্ষে মেনে নেওয়ায় অসুবিধা ছিল।

লোকসভায় হরিবিষ্ণু কামাথের মতো কয়েক জন সুভাষ-অনুরাগী তাঁর পরিণতি সম্বন্ধে পূর্ণ তদন্ত দাবি করলেও নেহরু তা নস্যাত্ করে দিতেন, বলতেন, নেতাজির মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। পাঁচের দশকের শুরুতে নেহরু পূর্বোল্লিখিত এস এ আয়ারকে দিয়ে জাপানে কিছু খোঁজখবর করিয়েছিলেন। একদা সুভাষের অনুগত হলেও আয়ার সাহেব রুটির কোন দিকে মাখন মাখানো থাকে খুব ভাল ভাবে বুঝতেন। তিনি নেহরুর মতকে সমর্থন করে তাঁর রিপোর্ট দিলেন, নেহরু তা সংসদকে জানিয়ে দিলেন।

নেতাজির মৃত্যু যে সন্দেহাতীত নয়, সে কথা জোর দিয়ে বলা শুরু করেন বিখ্যাত আইনশাস্ত্রী রাধাবিনোদ পাল। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনালের অন্যতম বিচারপতি রূপে তাঁকে দীর্ঘ দিন টোকিওতে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়েই নানা সূত্র থেকে তিনি জানতে পারেন যে তাইহোকু দুর্ঘটনা নিয়ে জাপানেই অনেকে অবিশ্বাসী। তিনি ভারতে ফিরে এসে এ কথা প্রকাশ করলে কলকাতায় রীতিমতো আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৫৫ সালে, আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানী শাহনওয়াজ খানের সভাপতিত্বে এক জনসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, কেন্দ্র সম্মত না হলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলেই একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক।

এ খবর পেতেই নেহরু তড়িঘড়ি মত বদলে একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ফেললেন শাহনওয়াজেরই অধ্যক্ষতায়। তিনি জানতেন কংগ্রেসের সাংসদ ও অন্যতম পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হিসাবে শাহনওয়াজ তাঁকে অমান্য করতে পারবেন না। বাকি দুই সদস্য ছিলেন সরকারের পক্ষে শঙ্করনাথ মৈত্র, আইসিএস এবং বসু পরিবারের প্রতিনিধি রূপে নেতাজির সেজদা সুরেশচন্দ্র বসু।

১৯৫৬ সালে কমিটি নেতাজিকে সরকারি ভাবে মৃত ঘোষণা করা সত্ত্বেও বিতর্ক কিন্তু থামল না। ওই সময় থেকে উত্তর ভারতের নানা জায়গায় এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে দেখা যেত যিনি সর্বদা নিজের মুখ ঢাকা দিয়ে থাকতেন আর পর্দার আড়াল থেকে লোকের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি এ কথাও বলতেন, তাঁর কোনও নাম নেই। কয়েক জন প্রাক্তন বাঙালি বিপ্লবী তাঁকে নেতাজি বলে সনাক্ত করলেন। ষাটের দশকে উত্তরবঙ্গের শোলমারী গ্রামে শারদানন্দ নামে এক সাধু উদিত হলেন, সারা দেশে রটে গেল তিনি নাকি নেতাজি। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা দফতর থেকে বসু পরিবারের লোকজন, সকলে সেখানে হাজির হলেন। অনেক বছর পরে অবশ্য প্রমাণ হয়েছিল তিনি এক প্রাক্তন বিপ্লবী, নেতাজি নন। ইতিমধ্যে বিদেশ দফতরের প্রাক্তন অফিসার ও কংগ্রেস সাংসদ সত্যনারায়ণ সিংহ তাইহোকু-মান্চুরিয়া গিয়ে বেশ কিছু লোকের দেখা পেলেন যাঁরা ১৯৪৫-এর পরেও নেতাজিকে ওই এলাকায় দেখেছে। রাশিয়া গিয়ে তিনি আর এক পরিচিতের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে, নেতাজি দীর্ঘ দিন সাইবেরিয়ায় বন্দি ছিলেন, তাঁর সেলের নম্বরও তিনি প্রকাশ করলেন। সিংহজি দাবি করেন তিনি নেহরুকেও এ কথা জানিয়েছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা চন্ডুখানার কিস্সা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এই সব তথ্যের ভিত্তিতে সাংসদ সমর গুহ নতুন করে নেতাজি সম্বন্ধে তদন্ত দাবি করলেন এবং সাংসদের চাপে সরকারকে তা মানতেও হল। বিচারপতি জি ডি খোশলার নেতৃত্বে এক তদন্ত কমিশন কাজ শুরু করল ১৯৭০ সালে। খোশলা কমিশন চার বছর ধরে, আধখানা এশিয়া ঘুরে, ২২৪ জন সাক্ষীকে জেরা করে, শাহনওয়াজ কমিটির সিদ্ধান্তকেই মেনে নিলেন। সমর গুহ ও অন্যান্যরা বহু চেষ্টা করেও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের জ্বলন্ত অসঙ্গতি ও পরস্পরবিরোধিতার দৃষ্টান্তগুলি বিচারপতির নজরে এল না। তাঁর পাল্টা জবাব ছিল, বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের ফলে যে ডামাডোল সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্যই অনেক কিছু ঠিকঠাক হয়নি।

জরুরি অবস্থার শেষে জনতা সরকারের আমলেও সমর গুহ চাপ অক্ষুণ্ণ রাখেন, যার ফলে মোরারজি দেশাই বলতে বাধ্য হন, খোশলা রিপোর্ট নেতাজি সম্বন্ধে শেষ কথা নয়। কিন্তু এর পরেই নেতাজির সাম্প্রতিক ছবি বলে একটি জাল ছবি প্রচার করে সমর গুহ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন, সুভাষবাদীদের আন্দোলনও জমি হারাতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে অযোধ্যায় রহস্যময় সন্ন্যাসী গুমনামী বাবার রহস্যময় জীবনাবসান আবার নেতাজি-বিতর্ককে জাগিয়ে তোলে। তত দিনে সুরেশ বসু প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর কন্যা লতিকা সাধুজির বাসস্থানে এসে তাঁর রেখে যাওয়া জিনিস পরীক্ষা করে বলে ফেললেন, সন্ন্যাসী সম্ভবত তাঁর রাঙাকাকাবাবু। শুনেছি, সাধুর শয়নকক্ষে সুভাষচন্দ্রের পিতা-মাতার ফটো টাঙানো ছিল, তাতে টাটকা ফুলের মালা ঝুলছিল। লতিকা বসুর আবেদনে হাইকোর্ট আদেশ দেয় যে, সন্ন্যাসীর যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি জেলাশাসক সযত্নে সরকারি তোষাখানায় সংরক্ষণ করবেন। সাধুর সম্পত্তি কিছু কম ছিল না, খান কুড়ি লোহার ট্রাঙ্কে ছোট-বড় প্রায় ২৭০০টি জিনিস ছিল।

নব্বুইয়ের দশকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা পূরবী রায় গবেষণার কাজে মস্কো গিয়ে কিছু কাগজের সন্ধান পান যার থেকে মনে হয়, বিশ্বযুদ্ধের পর নেতাজিকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্ন নিয়ে পলিটব্যুরোতে আলোচনা হয়েছিল। তিনি আরও খোঁজ করেন কিন্তু আর কিছু তাঁর হাতে আসেনি।

এ দিকে নেতাজি জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সরকারি মহল ও পরিবারের এক অংশ টোকিও থেকে তাঁর চিতাভস্ম ভারতে নিয়ে আসায় আগ্রহী হয়ে উঠলে কিছু অনুরাগী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। হাইকোর্ট সরকারকে নির্দেশ দেন যে নেতাজির তথাকথিত মৃত্যু নিয়ে যখন এখনও বিতণ্ডা চলছে, তখন সরকার যেন আর একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে বিষয়টির ফয়সালা করে। সেই আদেশ অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মুকুল মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে।

ছয় বছর পরে কমিশন ঘোষণা করে, তাইহোকু-তে কোনও বিমান-দুর্ঘটনা হয়নি, ওই ঘটনাটি সৃষ্টি করা হয়েছিল নেতাজিকে পলায়নের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। এত দিনের রূপকথার গল্প এ ভাবে শেষ হল। কিন্তু তত দিনে মনমোহন সিংহ সরকার ক্ষমতাসীন, তারা রিপোর্টটি মানতে রাজি হল না। আমরা আবার খোশলাতেই ফিরে এলাম।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts