বাবুল আহমেদ পারভেজ ॥ দেশের বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য তিনি, সততায়-সচ্ছতায় দৃষ্টান্ত, প্রধানমন্ত্রীর পরই তার অবস্থান। তারমাঝে রাখঢাক বলতে কিছু নেই। নিজে স্পষ্ট কথা বলেন, স্পষ্ট কথা শুনতে পছন্দ করেন। সুদীর্ঘ মন্ত্রীত্বের জীবনে এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই, যা তার ব্যাক্তিত্বকে সামান্যতম ম্লান করতে পারে। তিনি আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আজ তার ৮২তম জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি এই সর্বজন বরেণ্য এই মানুষটির জন্ম।
একজন মানুষের যে কত প্রতিভা থাকতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ মুহিত। একাধারে তিনি রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ ও ভাষাসংগ্রামী। রাজনীতিক হিসেবে তিনি যেমন অভিজ্ঞ, আবার ব্যাক্তিজীবনেও অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ। ইতিহাসের প্রতি ঝোঁক তার প্রবল। ইতিহাসচর্চা করছেন আজীবন। তার রচিত ৬০টিরও বেশি বইয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি ইতিহাসের। তার ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’ পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস।
তিনি এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নন। ’৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্টে সরাসরি এবং আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যোগদানকারী সাহসী সৈনিক তিনি। এদেশের স্বাধীনতায় তার অবদান অনেক। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী প্রথম সিএসপি অফিসার আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওয়াশিংটনের তৎকালীন পাকিস্তান দূতাবাসে প্রথম কূটনীতিবিদ হিসেবে তিনি তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন। পরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ওয়াশিংটন দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলরের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রবাসী সরকারের প্রতি বিশ্ব জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইতে মুহিত সম্পর্কে লেখেন, ‘এএমএ মুহিত ও হারুনুর রশীদ আমার সঙ্গে আমার নিউইয়র্ক পৌঁছানোর দিনই (২৪ মে, ১৯৭১) দেখা করতে আসেন। কিছু বলার আগেই তাদের বুকে বাংলাদেশের ব্যাজ দেখে আমি আনন্দিত হই। তারা তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যথাসময়ে অন্যান্য কূটনীতিবিদের সঙ্গে একযোগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবেন বলে জানালেন। অন্যান্য কূটনীতিবিদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানালেন। আমি বললাম যে ঘোষণাটাই বড় নয়, কাজটাই বড়। এএমএ মুহিত তখন পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার ও হারুনুর রশীদ ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করছিলেন।’
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন মুহিত। এ জন্য জেলও খেটেছেন। তিনি ছিলেন এসএম হল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ’৫৪-’৫৫ সালে। তার আগে ’৫২-’৫৩-তে ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি। ১৯৬৯-এ সেই ওয়াশিংটনে যাওয়ার পর থেকেই মুহিত সাহেব আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক, বিশেষ করে অর্থনীতি সম্পর্কিত সংগঠনগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন; বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে কাজও করেছেন বাংলাদেশের বিকল্প প্রতিনিধি হিসেবে।
অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার, জীবনের এই পড়ন্ত বয়সেও জনাব মুহিত একজন ভাল পাঠক। ৮০ বছর পেরিয়ে আজও তিনি ফার্স্ট রিডার। আজও দারুণ পাঠাভ্যাস তার।
পরিণত বয়সে এসেও তিনি সপ্রতিভ; মনজুড়ে সবুজ তারুণ্য। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য তার কর্মময় জীবন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএনডিপি, এসকাপ সদর দপ্তরে বসে তিনি বিশ্বের বহু দেশেরই অর্থব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখন দেখভাল করছেন বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থার। প্রাক্তণ অর্থমন্ত্রী এ এস এম কিবরিয়া প্রয়াত হওয়ার পর তিনি অদ্যাবধি শেখ হাসিনা মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে অটুট রয়েছেন। যার কোন বিকল্প নেই বলা যায়। ল্যাপটপ-ইন্টারনেটে দারুণ অভ্যস্ত তিনি। আধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বব্যাপি যোগাযোগ সচল তার। আজও চির হাস্যোজ্জ্বল তার মুখ।
সত্যিকারের পরিশ্রমী মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি তাদেরই একজন। ডিজিটাল, আধুনিকমনস্ক একজন ব্যক্তিত্ব। ল্যাপটপ নিত্যসঙ্গী। গভীর রাত অবধি কাজ করেন ল্যাপটপে। ভোরে হাঁটার কাজ বাদ যায় না কোনো দিনও। সবকিছুই তার গোছানো পরিপাটি, অফিস এবং বাসার পিসি আর হাতের ল্যাপটপ। সর্বদাই এক সবুজ প্রাণের মানুষ।
নিজের জন্মস্থানকে খুবই ভালোবাসেন মুহিত। তার গর্ব তিনি সিলেটি। পড়াশোনায় সবসময়ই মেধার স্বাক্ষর রয়েছে তার। ১৯৫১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন অনার্সে। ১৯৫৫তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করার পর অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে যান আবুল মাল আবদুল মুহিত। ১৯৫৭-৫৮তে অক্সফোর্ড এবং ১৯৬৪তে হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এ অর্থনীতিবিদ অনার্স ও মাস্টার্সে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।
কৈশোরে প্রগতিশীল মনের এই ব্যক্তিত্ব জীবনের এ পর্যায়ে এসেও প্রগতিশীল ভাবনায় চিরসবুজ। মানসিকভাবে একেবারেই অসাম্প্রদায়িক ও উদার। তার বঙ্গবন্ধু ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি অটুট বিশ্বাস। সর্বোচ্চ ভালোবাসা তার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। এ ভালোবাসা আর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি আস্থাবান।
স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতে বিশেষজ্ঞ, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।
শুভ জন্মদিনে তাকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি শতায়ু হোন, সক্রিয়-সরব থাকুন, এই আমাদের প্রার্থনা।
বাবুল আহমেদ পারভেজ॥সংগঠক, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সমন্বিত উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।