আবিদ রহমান
ঈদের ছুটিতে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা ছিল রমজানের শুরুতেই। ট্যুর প্ল্যানটাও ছিল রেডি। প্ল্যান অনুযায়ী ঈদের দিনটা বাসায় ঘুমিয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিলাম। ভ্রমণসাথী আমার দুই ভাগ্নে (রাকিব ও শামীম) এবং সুপরিচিত এক ছোট ভাই (সোলেমান) আর আমার কলিগ (লিটু ভাই)।
সন্ধ্যা ৮টার দিকে ব্যাগ গুছিয়ে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সিলেটের লোকাল বাসগুলো ৪৭০-৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া হাঁকাচ্ছে। লাক্সারি বাসের কথা আর নাই বা বললাম! অনেক কষ্টে এক বাসের ড্রাইভারকে জনপ্রতি ৩০০ টাকায় রাজি করানো গেল। আমরা এতেই খুশি। রাত পৌঁনে এগারোটায় বাস ছাড়লো। শুরু হলো আমাদের সিলেট যাত্রা।
বাস রাত দেড়টার দিকে ভৈরব বাজারে ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি দিল। সেখানে হাল্কা নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর আবার। ভোর ৪টায় বাস কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে থামল। পাশের সিএনজি স্ট্যান্ডে গিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে সিএনজি ভাড়া করলাম মাজারগেট পর্যন্ত। ঘণ্টাখানেক হযরত শাহজালাল (রা.) এর মাজার ঘুরে ভোর আনুমানিক ৫টার দিকে সোজা চলে গেলাম সিলেটের আম্বরখানায়। সেখান থেকে সিএনজি ভাড়া করলাম হাদারপার পর্যন্ত। ভাড়া নিল ৬০০ টাকা। রাস্তা মোটামুটি ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের।
প্রথম অর্ধেকটা পথ ভালই ছিল। সিএনজি থেকেই মালনীছড়া চা বাগান আর বিমানবন্দর দেখা যায়। বাকি পথটা ছিল নরক যন্ত্রণা। পুরো রাস্তাটাই ভাঙ্গাচোরা। তবে পথের দু’ধারের হাওর আর ছায়াশীতল শান্ত পরিবেশ আমাদের মুগ্ধ করেছে। সাড়ে ৬টার দিকে আমরা হাদারপার পৌঁছাই। সিএনজি মামারা (চালক) একটা সংঘবদ্ধ চক্র। মাঝপথে এসেই চালক মোবাইলে খাঁটি সিলেটি ভাষায় একজনের সঙ্গে মোবাইলে বলল, সে যেন হাদারপার এসে অপেক্ষা করে। আমরা হাদারপার এসে দেখতে পাই আগে থেকেই একজন নৌকার মাঝি এখানে বসে আছে। আমাদের বুঝতে আর বাকি রইল না যে মোবাইলের সেই ব্যক্তিই এই মাঝি।
আমরা সিএনজি থেকে নেমে হাতমুখ ধুয়ে একটা মুদি কাম মিনি হোটেলে যাই। সেখানে ২০ টাকা প্লেট খিচুড়ি খেয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাঝি বলল, কোথায় যাবেন ভাই? আমি বললাম, বিছনাকান্দি, পান্থুমাই আর লক্ষণছড়া যাব। ভাড়া কত? সে একবারে দাম হাঁকাল ৩ হাজার টাকা। আমদের তো মাথাই নষ্ট, বলে কি!
যেহেতু মেঘালয় খুব কাছে তাই সেদিন একটু পরপর টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। দূরে মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে সফেদ মেঘের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝর্ণাগুলো অসাধারণ লাগছিল। অতি মনোরম দৃশ্য যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
ঘাটে দেখলাম একটা ছোট নৌকা। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবে। মাঝি বলল, ওপারে যাবে অর্থাৎ পাশের গ্রামে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, শুনেছি হেঁটে বিছনাকান্দি যাওয়া যায়, সেটা কিভাবে একটু বলবেন? মাঝি বলল, ওপারে গিয়ে মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ৫০ টাকায় বিছনাকান্দি যাওয়া যায় আবার হেঁটেও যেতে পারেন। আমরা নৌকায় চড়ে বসলাম। এটা নদী নাকি হাওর জানি না তবে মাঝপথেই প্রচন্ড বৃষ্টি নামল। ভাগ্যিস ছাতা ছিল নইলে তুঘলকি কান্ড ঘটে যেত।
নৌকা থেকে পাহাড়গুলো আরও রূপবতী লাগছিল। ৮-১০ মিনিট পর আমরা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ওপারের গ্রামে পৌঁছলাম। বৃষ্টি থামলো আনুমানিক মিনিট বিশেক পর। দেখলাম যেখান থেকে গ্রামের রাস্তা শুরু সেখানেই ৩-৪টা মোটরসাইকেল দাঁড় করানো রয়েছে। বুঝলাম এগুলিতে চড়েই বিছনাকান্দি যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সিন্ধান্ত নিলাম গ্রামের চিরায়ত মেঠোপথ ধরেই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে বিছনাকান্দি চলে যাব।
শুরু করলাম হাঁটা। আমরা পাঁচজন, হাঁটছি তো হাঁটছিই। প্রায় আধঘণ্টা পর আমরা একটা খোলা মাঠে এসে পৌঁচ্ছালাম। একি! এত সুন্দর ঘনসবুজ মাঠ! আমার তো হতবাক লেগে গেল। মাঠের পেছনে পাহাড়ের রাশি। তার গায়ে মেঘের আনাগোনা । কি অদ্ভুত সুন্দর। এখান থেকেই বিছনাকান্দি স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু মাঠ আর বিছনাকান্দির মাঝখানে খরস্রোতা নদী। এর অর্থ হচ্ছে আমরা পথ ভুলে অনেকটাই সামনে চলে এসেছি। আমাদের হাঁটা পথের একপর্যায়ে বাঁ-দিকে মোড় নেয়ার কথা ছিল। না গিয়ে আমরা সোজা চলে এসেছি। তবে ভুলটাই আমাদের জন্য শাপে-বর হয়ে গেল। তা নাহলে এত সুন্দর একটা লোকেশন খুঁজে পেতাম না। পাহাড়কে পেছনে রেখে আমরা একের পর এক ছবি তুলতে থাকি।
ভুলেই গিয়েছিলাম আকাশ কখন ভারি মেঘে ঢাকা পড়েছিল। হঠাৎই তুমুল বৃষ্টি আরম্ভ হলো। আমরা ছাতা দিলেও এই মেঘালয়ের বৃষ্টির তোড়ের সঙ্গে পেরে উঠছিলাম না। অগত্যা দৌড়ে এক টিনশেড বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাড়িটা ছিল ওখানকারই স্থানীয় এক মাঝির। মাঝিভাই আমাদের ভারতের মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত পাতাবিড়ি অফার করল। আমাদের মধ্যে দু’একজন এর স্বাদও উপভোগ করল। মাঝিকে বললাম ট্রলারে করে বিছনাকান্দি পৌঁছে দিতে। তিনি আমাদের ১২০ টাকায় বিছনাকান্দি নিয়ে গেলেন। সময় লাগলো মাত্র ৫ মিনিট।
সেখানে আমরা কনকনে ঠান্ডা শীতল জলে গোসল করে পাশের বাজারে গেলাম। বাজার বলতে শুধু ভারতীয় প্রসাধনী আর শুকনো খাবার (চকলেট, আচার ইত্যাদি) পাওয়া যায় ওখানে। তবে দাম অনেকটাই চড়া। যাদের চোখ প্রকৃতগতভাবে কোটরের ভেতর তাদের চোখ বেরিয়ে আসার তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা সেখানে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে পান্থুমাইয়ের জন্য ট্রলার ভাড়া করলাম ১ হাজার ৪০০ টাকায়। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর নদী আর শাখা-নদী পেরিয়ে আমরা পান্থুমাই পৌঁছলাম। পথের বাড়তি পাওনা ছিল নদী ধারের গ্রামের দৃশ্য অবলোকন, তাদের জীবনযাপন অনুধাবন। আর পাহাড় তো আমাদের সঙ্গে ছিল প্রায় পুরোটা সময়ই। পাহাড়ের গায়ে দেখতে পেলাম মাটিকাটা রাস্তা যা দিয়ে ভারতীয় গাড়ি অনবরত যাতায়াত করে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। তবে প্রান্তদ্বয়ের নাম আমি জানি না।
পান্থুমাই নেমে জানতে পারি, এখানে প্রতি নৌকায় ২ জন করে লোক নিয়ে ঝর্ণার কাছাকাছি যাওয়া যায়, তবে পুরোপুরি কাছে যাওয়া যায় না। কারণ ঝর্ণাটা ভারতীয় বর্ডারে। ঝর্ণার ঠিক উপর একটি সেতু আছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ভারতীয় পর্যটকটা এর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। পান্থুমাইয়ের ঘাটেই একটা চায়ের হোটেল আছে। সেখানে সিঙ্গারা আর চা খেয়ে আবার ট্রলারে উঠে পড়ি। ট্রলার ছাড়ার মিনিট বিশেক পরই আবারও তুমুল বৃষ্টি শুরু। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। মাঠে চড়ানো গরুগুলো নদীতে নেমে সাঁতরে ওপারের গ্রামে যাচ্ছে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় জেলেরা জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরছে। নাম না জানা পাখিরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে উড়ে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। তখন আনুমানিক সাড়ে ৩টা বাজে। মাঝি আমাাদের আবার হাদারপার নামিয়ে দিল। বাজারের একটা স্থানীয় হোটেলে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। খরচ আনুমানিক ৯০ টাকা। এখানে খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।
হাদারপার থেকে আমরা আবার সিএনজি ভাড়া করলাম এক হাজার টাকায়। সে আমাদের রাতারগুল নিয়ে যাবে এবং সেখান থেকে আবার আম্বরখানা পৌঁছে দেবে। আমাদের তখন শারীরিক শক্তি প্রায় নিঃশেষ। সিএনজিতে বসে আমরা সকলে ঝিমুচ্ছি। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর আমরা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে গেলাম। তখন বিকেল ৫টার বেশি বাজে। মাঝিরা অনেক বেশি ভাড়া চায় এখানে। আবারও ক্লান্তিকর মুলামুলি (!) শুরু। একটা কিশোর মাঝিকে আমরা রাজি করালাম ৬০০ টাকায়। সে আমাদের ফরেস্টের ভেতর ঘুরালো প্রায় ৫০ মিনিটের মতো। রাতারগুলের ভেতরটা দেখলে মনে হয় এ্যামাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অনেক সুন্দর। হিজলসহ নাম না জানা হরেকরকম গাছ পানিতে অর্ধেকটার বেশি নিমজ্জিত হয়ে আছে। মুহুর্মুহু পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এর শান্ত পরিবেশ।
সিএনজিতে করে আমরা আম্বরখানায় পৌঁছে হোটেলে ঢুকে পড়ি। নানরুটি আর গ্রিল আমাদের এবারের রাতের খাবার। সঙ্গে কোমল পানীয়। খরচ মোটামুটি জনপ্রতি ১৪০ টাকা। রাত তখন প্রায় ৯টা। আমরা হেঁটে আম্বরখানা থেকে ঐতিহাসিক কিম ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়াই। ব্রিজের নিচে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আর ভাবতে থাকি প্রকৃতির কাছে আমাদের কত কিছুই না শেখার আছে, জানার আছে, দেখার আছে। আমরা এর কতটুকু জানি, কতটুকু উপলব্ধি করি।
বলতে বলতে রাত সাড়ে ১০টা বেজে যায়। আমরা আবার ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে চলে আসি বাসস্ট্যান্ডে। লোকজন নেই বললেই চলে। সবগুলো বাস-ই প্রায় অর্ধেক খালি। একটা লাক্সারি বাস দেখে আমার আবারও যথাসম্ভব কম ভাড়া অফার করলাম। আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র ২০০ টাকায় কন্ডাকটর রাজি হলো।
বাসে বসে আমি মনে মনে বললাম, প্রকৃতি যেন আমাদের এভাবেই অপার হস্তে তার অসামান্য সৌন্দর্য দান করতে থাকে। হাজার হলেও তার রূপের ঝলক কোনদিন শেষ হওয়ার নয়, যতদিন আমরা তার কোন ক্ষতি না করি।