আখতার-উজ-জামান ॥ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঢাকার রাজপথে সেদিন রক্ত দিয়েছিল সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ বাঙালি তরুণ যুবকরা। সেদিন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলতে অনেকের অগ্রণী ভূমিকাও ছিল। এদের মধ্যে আলোচিত হলেন-ভাষা সেনিক গাজীউল হক, ভাষা মতিন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহা উল্লেযোগ্য। এরা সকলেই বাংলা ভাষার ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন।
এর বাইরে আরো অনেক ভাষা সৈনিক আছেন যাদের নাম আমরা জানি না। জানলেও প্রচার বিমুখতার জন্য তাদের অনেককে আমরা চিনি না। এদের মধ্যে একজন হলেন ভাষা সৈনিক হাজী আবু নুর এম ডি শামসুল ইসলাম (নুরু মোল্লা)।
বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে এই ভাষা সৈনিক নুরু মোল্লার জন্ম। এই বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনীতে জন্মেছেন আরেক ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। কিন্তু তার কর্মকান্ড ছিল বগুড়ায়। নুরু মোল্লা ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সঙ্গে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) যুক্ত ছিল। এই যুক্ত অংশটির মূল ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ভাষা ছিল উর্ধু। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্ধুকে পকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদি বাঙালিরা চাপিয়ে দেয়া উর্ধু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি। আর মেনে না নেয়ার কারণে ৫২’র সালের ২১শে ফেব্র“য়ারীতে রক্ত দিতে হয়েছিল বাঙালীদের।
সে সময় বাংলা ভাষা রার দাবিতে সর্বদলীয় সেন্ট্রাল কমিটি অব একশান নামে একটি কমিটি হয়। নুর মোল্লা ছিলেন সে কমিটির একজন সদস্য। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এ দাবিতে জনমত গড়ে তুলতে একশন কমিটির সদস্যরা তখন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে টিনের চোঙ্গা বানিয়ে রাস্তাার মোড়ে মোড়ে বক্তৃতা দিতেন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠে তখন পাকিস্তান সরকার সভা-সমাবেশ না করতে দেয়ার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।
ছাত্র এবং যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত একশন কমিটির নেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশ হবে। এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় আগের দিন অর্থাৎ ২০ ফেব্র“য়ারী রাতে তোহার বাসায়। ওই সভায় গাজীউল হকসহ একশন কমিটির অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় নুরু মোল্লা উপস্থিত থেকে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ঘোষনা দেন দৃঢ় কন্ঠে। সভায় সকলে সমর্থন জানান।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গোপনে জড়ো হতে থাকে ছাত্ররা। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা করবেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলে আমতলায় জড়ো হয়ে সভা করেন। গাজীউর হক সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন। তিনি একটি ভাঙ্গা টেবিলের উপর দাড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। এরপর মিছিল বের হলে আগে থেকে ওৎপেতে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মিছিলে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন আহত হন অনেকে। পুলিশ মিছিল থেকে অনেককে গ্রেফতার করে। পালিয়ে যান অনেকে। পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে নুরু মোল্লাও ছিলেন। তখন তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু একটি লাশ গোপনে লুকিয়ে ফেলেন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারী তারা এই লাশ নিয়ে মিছিল বের করলে পুলিশ পুনরায় মিছিলে গুলি চালায়। গুলিতে দুইজন শহীদ হন। ঘটনাটি ছিল কার্জন হলের সামনে।
ঢাকায় যখন ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় তখন তৎকালিন আওয়ামী লীগের তরুন নেতা ও পরবর্তী স্বাধীন বাংলার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর কারাগারে আটক ছিলেন। তিনি পুলিশের নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে কারাগারে অনশন করেন। এদিকে এ ঘটনার পর সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলন গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। একশন কমিটির পে নুরু মোল্লা এবং ডা. আব্দুস সাত্তার ২৪ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম যান এবং লালদীঘি ময়দানে সমাশেন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী সমাবেশ করেন নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজের সামনে। হাজী আবু নুর এমডি শামসুল ইসলাম একজন ভাষা সৈনিক এ কথা অনেকের কাছে অজানা। তিনি প্রচার বিমুখ হওয়ায় তার নাম ভাষা সৈনিকদের তালিকায় আসেনি।
সম্প্রতি তিনি জীবন সায়ান্নে এসে ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহনের ব্যাপারে মুখ খুললেন। তিনি বলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ৭১ এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল মালেক উকিলের সঙ্গে ভারতে চলে যান। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করেন। তিনি লক্ষ্মীপুর, রামগঞ্জ, পোদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশে নেন।
নুরু মোল্লা একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেন তেমনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধেও সমান খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বয়সের ভারে কিছুটা নূজ্য হলেও এখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। তিনি বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য।