যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি কালজয়ী

আখতার-উজ-জামান ॥  একুশ বলে দেয় আজকের বর্ণমালা: অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, প, এ, ভ, ম শ, – এই অক্ষরগুলোই আমাদের প্রাণ, জয়ের গান, বিশ্বের দরবারে পরিচয় করে দিতে যার ভূমিকা অপরিসীম।

মায়ের ভাষা কথাটির পেছনে অনেক রক্তঝরা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ দিনটিকে আরও স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষেরা আজকের এই পৃথিবীর মানচিত্রে সম্মান জানিয়েছে আমাদের এই ভাষা শহীদদের প্রতি।

পাকিস্তানী জান্তারা বরাবরই বাংলার মেধাবীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল মেধা শূন্য করে তাদের উর্দু ভাষাকে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব; বাংলার মায়ের সন্তানেরা  যেকোন অপশক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি  আজ কালজয়ী।

আজ আমরা অনেক কিছুতে বিশ্বের দরবারে জানান দিতে পেরেছি মেধা বিকাশের মাধ্যমে। যেখানে আজ পৃথিবীর মানচিত্রে সিয়েরালিওন নামক রাষ্ট্রটি পর্যন্ত আজ আমাদের মায়ের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ঐতিহাসিক গানটি পরিবেশন করে।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কিংবা পর্যালোচনার ইতিহাস সবারই জানা। তারপরও এই মাতৃভাষার ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করে রাখতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পুণরায় প্রকাশ করতে হলো এই প্রজন্মের কাছে। কারণ নতুন প্রজন্মকে আরও বেশী দেশ প্রেমী চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে পূর্বের ইতিহাসকে স্মরণ করে। উৎখাত করতে হবে ১৯৫২, ১৯৭১’এর সেই পাকিস্তানী অপশক্তিকে। তাই সাড়ে ষোল  কোটি বাঙালী সজাগ থাকবে সকল অপশক্তিকে পরিহার করে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই স্মরণীয় দিনটিকে মনে রেখে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে দ্বি-জাতি তত্তের উপর ভিত্তি করে। পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী,  উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল কিভাবে কেড়ে নেবে এই বাংলা মায়ের মুখের ভাষা।

প্রখ্যাত লেখক ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভুইয়া’র ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন’ নামক বইয়ে দেখা যায়- বাংলা ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি- ২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দু-৬%, সিন্ধি-৪.৮% এবং ইংরেজি ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ১.৪। তাহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলা ভাষার আনুপাতিক হার ছিল সবচেয়ে বেশী।

মাত্র শতকরা ৬ শতাংশ ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানী স্বৈর শাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয় একের পর এক নির্যাতন ও বর্বরোচিত হামলা করে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে একইবারে সর্বশান্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু মায়ের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে এই বাংলার আকাশে বাতাশে তখন ধ্বণিত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই নামক শ্লোগান।

১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারত বিভাগের ১৯ তম দিনে “তমুদ্দন মজলিস” গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেন।

ঐ বছরের ১৫  সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ” শিরোনামে এই সংগঠনের উদ্যোগে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়, যা ভাষা আন্দোলনের ঘোষণা পত্র নামে পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেমী মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার প্রথম উদ্যোক্তা। তার উদ্যোগেই তমদ্দুন মজলিস নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকায় সর্ব প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গঠিত হয় । ঐ বছরই পাকিস্তান গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ বিশেষত কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি জানান ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য।

কিন্তু ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan “ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।”

তিন দিন পরে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে তিনি যখন একই ঘোষণার পুণরাবৃতি করেন, তখন উপস্থিত ছাত্ররা না না না ……. বলে এর প্রতিবাদ জানায়।

ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ৮ বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও রাষ্ট্রভাষার  দাবীতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।

১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পুণরায় একই  ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুন  ক্ষোভ ও হতাশা তৈরী হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ।

এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারী ঢাকাতে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।  ঐ দিনই এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে।

উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তখনকার গভর্ণর নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা সকল ভয়কে উপেক্ষা করে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকে। তারা এতে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে সংগাম চালিয়ে যায়। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১  ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনি পুলিশ মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ করে।

ফলে মিছিল কিছুটা ছত্র ভঙ্গ হয় এবং রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার সহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র শহীদ হন। সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের আপামর ছাত্র সমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা বাংলা অর্জিত হয়েছে তার গন্ডি তখন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে।

তাই ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশ গ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে।

২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে। এই মাসটিকে আর স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং সরকারীভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করা হয়।

আজ আমরা হাসি-আনন্দ, দু:খ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করি মায়ের ভাষায়। মাতৃভাষা দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশ প্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts