মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান
জার্মানির মিউনিখে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক ‘নাগরিক সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল।’ ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু এতটাই জড়িত ছিলেন যে, যতদিন বাংলাভাষা থাকবে ততদিনই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু বাঙালীদের মানসপটে চির জাগ্রত থাকবেন।
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রধান পরিচয়ই ভাষা আন্দোলন মাস হিসাবে। উনিশ শো বাহান্নর ফেব্রুয়ারী মাসে বিশেষ করে ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার কারণে আজ সারা পৃথিবীতে একুশে ফেব্রুয়ারী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে। সেই নিরিখে ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক গৌরবোজ্জল অধ্যায় সৃষ্টি করেছে, যেমনটা পৃথিবীর আর কোন দেশের পইে সম্ভব হয়নি। অনেক ইতিহাস বিশ্লেষক যে দাবী করেন, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটেছে, এ সত্য আর এখন অস্বীকার করার আর কোন উপায় নেই।
অথচ দু:খের বিষয় জাতির ইতিহাসের এই মহা-মহা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভাষা আন্দোলনের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমরা অনেকে প্রায় জানিনা বললেই চলে। ভাষা আন্দোলন কবে, কিভাবে, ইতিহাসের কোন পটভূমিতে শুরু হয়েছিল, আর তার সমাপ্তিই বা কিভাবে হয়েছিল সেসব আমরা না জানাতে আমরা শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারী পুষ্পার্ঘ অর্পণের আনুষ্ঠিকতার মধ্যে ভাষা আন্দোলন উদযাপন সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। অনেকেরই মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে ভাষা আন্দোলন বুঝি একুশে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি ঘটনা ছিল।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি উল্লেখ করেন- জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর ১২.০১ মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তিনি তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।”
জাতির পিতার এই মহামূল্যবান বক্তব্য থেকে এসে যায়, যে আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছিল আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রকাশের সংগ্রামের এবং যখন পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটা সৃষ্টি হয় এবং যখন ব্রিটিশরা ভারতে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করে গেল, একটা পাকিস্তান, একটা ভারতবর্ষ। ঠিক সেই সময় নানা আলোচনা শুরু হয়। আর তখন থেকেই ভাষার বিষয়টা উঠে আসে।
ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। আজন্ম মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব এবং পরবর্তী সময় আইন সভার সদস্য হিসেবে এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে গেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের দাবির কথা বলে গেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলেন। ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরীক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইস্তেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইস্তেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ঐতিহাসিক এই ইস্তেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। উক্ত পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিব নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে বারবারই বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ পাকিস্তানী দোসররা নানাভাবে সেসব ইতিহাস মুছে ফেলার প্রয়াস চালিয়েছে। হয়তো আগামীতেও এমন প্রয়াস তারা সুযোগ পেলেই চালাবে। তাই প্রজন্মকে আমাদের শিকড়ের ইতিহাস জানতে হবে। এবং ইতিহাস নিয়ে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান : সাধারণ সম্পাদক, বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম সংগ্রামী ঐক্য পরিষদ- কেন্দ্রীয় কমিটি।