: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘অনিয়ম’ নিয়ে ‘গণশুনানি’ করেছে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে জোটের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে দিনব্যাপী এই ‘গণশুনানি’ অনুষ্ঠিত হয়।
কথা ছিল এই গণশুনানিতে একাদশ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে যেসব প্রার্থী অংশগ্রহণ করেছে তাদের ৩০০ জনই অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরবে। সমস্ত অনিয়ম-কারচুপির একটা সমন্বিত দলিল বা নথি তৈরি হবে। তারপর সেই তথ্যপ্রমাণ বা দলিলের ভিত্তিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন হবে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন মাঠে মারা গেছে। গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করেননি ফ্রন্টের বড় শরিক বিএনপির অনেক প্রার্থী। এমনকি ২০ দলীয় জোটের তিন জন প্রার্থী ছাড়া বাকিদের কারও দেখা মেলেনি গণশুনানিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ঘুমুচ্ছেন! অবশ্য গণশুনানির বক্তব্য শুনতে শুনতে এই বসন্তদিনে হতাশ-ক্লান্ত বিরোধীদলের নেতাদের ঘুম আসা খুবই স্বাভাবিক!
বিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত এই গণশুনানির কারণ-উদ্দেশ্য-ফলাফল নিয়ে নিয়ে বাহুল্য আলোচনা না করে আমরা বরং অনুষ্ঠান চলাকালে নেতানেত্রীরা যে আবেশে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই ‘ঘুম’ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করতে পারি।
অনেকে আপত্তি জানাতে পারেন; ঘুম হওয়া বা না হওয়াকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে এর প্রতি উদাসীনতা দেখানোর কথা বলতে পারেন। যদিও বিষয়টি এত তুচ্ছ নয়। আসলে ঘুম নিয়ে গভীর আলোচনার অবকাশ আছে। অবহেলা, অবজ্ঞা আর উপেক্ষার কারণে অনেক ছোট ছোট সমস্যা পরবর্তী সময়ে সংকটে পরিণত হয়। সমস্যা যখন একটু একটু করে বড় হতে হতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তখন আমাদের হুঁশ হয়। কিন্তু ততোক্ষণে সব কিছু প্রতিকারের বাইরে চলে যায়। কাজেই কোনো সমস্যাকে ছোট বা লঘু করে দেখা উচিত নয়। গণশুনানির সময় ঘুম হওয়া বা ঘুম না হওয়াকে তো নয়ই।
ঘুম না হওয়া আধুনিক মানুষের জীবনে মহামারির মতো নেমে এসেছে। টিভি-সিনেমা-চ্যাটিং-ফোনালাপ ইত্যাদি করে যুব-সমাজের তো ঘুম লাটে ওঠার যোগাড়। অবশ্য এর মধ্যেও কারো কারো চমৎকার ঘুম হয়। অনেকে ঘুমের মধ্যে মজার সব স্বপ্নও দেখেন। ঘুম জিনিসটাই ভয়ানক গোলমেলে। কারো খুব ভালো ঘুম হয়। কারো কারো একেবাড়েই হয় না। কারো সামান্য কাজ চালানোর মতো ঘুম হয়, একেকজনের একেক রকম।
ঘুমের শ্রেণিভেদ আছে। পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ আছে। বড়লোকের ঘুম, গরিবের ঘুম, বর্ষার ঘুম, শীতের ঘুম (ব্যাঙের ক্ষেত্রে ‘শীত-নিদ্রা’)। সশব্দ ঘুম (নাসিকা গর্জনসহ), নিঃশব্দ ঘুম। বৃহস্পতিবার রাতের ঘুমের চেহারা এক রকম (কারণ শুক্র-শনিবার ছুটি)। রবি-সোমের আলাদা। মাসের শুরুতে একরকম, শেষের দিকে ভিন্ন। শেখ হাসিনার ঘুম, খালেদা জিয়ার ঘুম। সাইদীর ঘুম। রবীন্দ্রনাথের ঘুম। ঐশ্বর্য রাইয়ের ঘুম, ডিপজলের ঘুম। আরো অনেকের ঘুম আছে। সিভিলিয়ানের ঘুম, আর্মির ঘুম। মানুষের ঘুম, জন্তু-জানোয়ারের ঘুম। ইচ্ছা করলেই সিপিডি ঘুমের আর্থ-সামাজিক ভূমিকা নিয়ে একটা সেমিনার করতে পারে। ড. আনিসুজ্জামান ‘বাংলা সাহিত্যে ঘুমের প্রভাব: স্বরূপের সন্ধানে’, মুনতাসীর মামুন ‘ঢাকা নগরীর ঘুমের ইতিহাস’, আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ঘুম’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘ধ্রুপদী নায়িকাদের ঘুম’, এমাজউদ্দিন আহমদ ‘জিয়ার রাজনীতিতে ঘুমের প্রভাব’, ড. কামাল হোসেন ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ঘুম’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখে ফেলতে পারেন। ঘুমের কি আর শেষ আছে? এ নিয়ে যে কোনো লিটিল ম্যাগ ঢাউস সাইজের একটি বিশেষ সংখ্যাও হতে পারে।
ঘুম নিয়ে অনেক গান আছে, কবিতা আছে। অনেক গানের মধ্যে ঘুম আছে। কিছু কিছু গান শুনলে ঘুম আসে। কিছু গানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো । ঘুম তো আসেই না, বরং মাথায় খুন চেপে বসে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন: ‘পিতামহের শ্মশাণে গিয়ে আমি মরে যাবার বদলে মাইরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ বাস্তবে অনেকে আবার ঘুমিয়ে যাবার বদলে মরে যায়- চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। অবশ্য ঘুমকে মৃত্যুর কাছাকাছি ভাবা কবি ও দার্শনিকের এক পুরানো স্বভাব। মৃত্যুকে কাব্য করে ‘মহানিদ্রা’ বলা বহুদিন ধরে চলে আসছে। ইংরেজি কবি শেলি সাহেব ঘুমকে ‘মৃত্যুর ভাই’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ঘুমের আরো প্রকার আছে। কারো ক্ষেত্রে ঘুম ব্যাপারটা অভ্যাসের মতো। আর দশটা প্রত্যহিক কাজ যেনো বা। অনেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আয়াসসাধ্য। কারো ঘুম দীর্ঘস্থায়ী। কারো কারো ক্ষণস্থায়ী। আসে যায়, আসে যায়। যারা বিছানায় গেলেই ঘুমিয়ে পড়ে, তারা সুখী প্রকৃতির লোক। ঘুমের আরো স্তরভেদ আছে। সাধারণত ঘুমিয়ে পড়া মাত্রই এ স্তরের বিবর্তন লক্ষ করা যায়। কাৎ থেকে চিৎ, চিৎ তেকে উপুর, উপুর থেকে কুকুর-কুণ্ডলী, কুণ্ডলী থেকে কুমড়ো-গড়ানি, তারপর খাটে থাকলে মেঝেয়, আর মেঝেতে থাকলে দেয়ালের গায়ে কুঁকড়ে একেবারে লেপ্টে যাওয়া- এ ধরনের একটা স্তরভেদ থাকে। তবে এসবই অহিংস প্রকৃতির ঘুম, এতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। তবে হিংস্র প্রকৃতির ঘুমও আছে, যা এত মারাত্মক যে তার আশেপাশে কাছাকাছি এমনকি পাশের ঘরে থাকাও রীতিমতো রিস্কি। যেমনি ঘুম এলো অমনি দমাদম হাত-পা ছোড়া শুরু হলো, সোজা কিল, ঘুসি, লাথি একযোগে। দাম্পত্য জীবনে এ ধরনের ঘুমের জন্য ইউরোপে নাকি ডিভোর্স পর্যন্ত হয়। আমরা বাঙালিরা কিল খেয়ে কিল হজম করার বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী বলে এখানে তেমন কোনো গুরুতর সমস্যা হয় না।
আমাদের জীবনে প্রথম ভাগে ‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি’র গান শুনিয়ে দাদী-নানীরা ঘুম আনানোর চেষ্টা করতেন। শৈশবে আমরা যখন ঘুমাতে চাইতাম না, তখন ঘুমের জন্য পীড়াপীড়ি করা হতো। আর যখন ঘুমিয়ে থাকতে চাইতাম, তখন মা আমাদের ঠেলে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দিতো। এখন অবশ্য সে চিত্র পাল্টে গেছে। এখন বাবা মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশুরাও ঘুমাতে যায় এবং ঘুম থেকে জাগে। স্যাটেলাইট টিভি, ল্যাপটপ, আইপড, স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ফোর জি-ফাইভ জি ইত্যাদির গোলকধাঁধায় এ যুগে আর ঘুমানোর অবসর কোথায়?
তবু মানুষ ঘুমায়। ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম বা নির্ঘুম অবস্থা নিয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে। আর শুধু ব্যক্তি ঘুমায় না, জাতিও ঘুমায়। যেমন বাঙালি জাতির ঘুম। এ জাতির ঘুম হচ্ছে কালঘুম। কবে যে এই ঘুম ভাঙবে, আদৌ ভাঙবে কি-না, তা কেউ জানে না!
ঘুমের একটি ভয়াবয় রূপ হচ্ছে জেগে জেগে ঘুম। জেগে জেগে যারা ঘুমায়, তাদের কখনো জাগানো যায় না (সুন্দরীরা যেমন ঘুমায়, প্রেমপ্রার্থীর পাঁজরছেঁড়া আকুতি তারা দেখেও দেখে না)। আমাদের দেশের নেতানেত্রীরাও জেগে জেগে ঘুমায় বলে অভিযোগ শোনা যায়। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের যে, ঘুমানো বা না ঘুমানো কিংবা জেগে জেগে ঘুমানো নিয়ে রাষ্ট্র বা সমাজের কোনো মাথাব্যথা নেই। মানুষ নামক ‘কুলাঙ্গার’কে বাগে আনতে সমাজে হাজারটা লিখিত-অলিখিত আইন আছে। অনুশাসন আছে। যেমন রাস্তায় ‘প্রাকৃতিক’ কাজ সারা যাবে না। মনের মধ্যে যতো প্রবল বৈশাখী ঝড়ই উঠুক না কেনো, রাস্তাঘাটে ইচ্ছা হলেই কাউকে প্রেম নিবেদন করা যাবে না; জাপটে ধরা চলবে না। টিএসসিতে বসে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া যাবে না। অপছন্দের কোনো ব্যক্তিকে নাক বরাবর উদ্দেশ্যহীন অথবা উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ঘুষি মারা চলবে না। প্রকাশ্যে মদ খাওয়া যাবে না। ইচ্ছে হলেই শুধু ‘পাগলা ঘণ্টি’র আওয়াজ শুনতে দমকলকে ডাকা চলবে না। এ ভাবে চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে শুধু ‘না’ আর ‘না’। ‘না’ প্রভাবিত আমাদের সমাজ প্রকল্প। ‘না’ শাসিত রাষ্ট্রযন্ত্র। কেবল ঘুমের ক্ষেত্রে ব্যপারটা আলাদা। কেনো বিধিনিষেধ নেই, কালা কানুন নেই। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নেই, রাষ্ট্রীয় নীতি নেই। দাতাদের প্রেসক্রিপশন নেই। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। অথচ ঘুম রীতিমতো একটি জাতীয় সমস্যা। অতি ঘুম নিয়ে অনেকেরই পারিবারিক সঙ্কট দেখা দেয়।
সভ্যতার শুরুতে মানুষের ঘুমহীনতা ছিলো না। কেননা তখন মানুষ ভাবতে জানতো না। ভাবনা যতো বাড়ছে, ঘুম ততো কমছে। আধুনিক সভ্যতা যদিও মানুষকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে ঘুম। ইউনিকটিন. সিডাক্সিন, রিলাকজিন। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফাইভ এমজি করে এক ঢোকে গিলে খাও। জীবনের অনিবার্য হতাশা ব্যর্থতা অতৃপ্তির জ্বালা মেটাতে অনেকে টেন এমজি এক পাতা মেরে দিচ্ছে। এক সময় ঘুমহীন যুব সমাজের মধ্যে ফেনসিডিল বা ‘ডাইল’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঘুমসংকটগ্রস্তরা ইদানীং ইয়াবাসহ নানা কিছু গিলছে। সেসব দিব্যি হজমও করে ফেলছে। যদিও তাতে মুক্তি মিলছে না। আচ্ছন্নের মতো একটা ছেড়ে আরেকটার পেছনে ছুটছে। এই ছোটার যেন কোনো শেষ নেই!
তবে গণশুনানির মঞ্চে যারা কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান, ঘুমুতে পারেন, তারা নিঃসন্দেহে অনেক সুখী ব্যক্তি। অনিদ্রা আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের অনুসরণ করতে পারেন। ঘুমাবার কৌশল হিসেবে তারা পারিবারিক পর্যায়ে বিশেষ কোনো ইস্যুতে একটা গণশুনানির আয়োজন করে দেখতে পারেন! নিদ্রাহীনতা সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে!
চ্যানেলআই অনলাইন