পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল

শিউল মনজুর বেসরকারী এমপিও ভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন স্কেলে বেতন প্রাপ্তির বিষয়টি আবারো পেছালো। অনেক পথ ঘাট পেরিয়ে অবশেষে আশা করা গিয়েছিল যে, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন-ভাতা মার্চ-২০১৬ তে অষ্টম বেতন স্কেলে প্রদান করা হবে। কিন্তু তা হয়নি।

জানা গেছে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন বিল পুরনো স্কেলেই হচ্ছে। অর্থ্যাৎ এমপিও ভূক্ত পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের আশার প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা প্রদর্শন করাই হচ্ছে বা বলা যায় গুরুত্বহীনভাবে তাঁদের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলেই নতুন স্কেলে বেতন পাবার বিষয়টি আবারো পেছালো।

আর এইভাবে বারবার পেছানোর কারণে পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের আশা অনেকটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ভবিষ্যতের সুতোয় ঝুলছে। এখন সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন স্কেলে বেতন পাবার বিষয়টি সন্দেহের চোখেই দেখছেন। আদৌ  বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন স্কেলে বেতন পাবেন কিনা তা নিয়ে এক ধরণের ধুম্রজালও সৃষ্টি হয়েছে।

বিগত সময়ের প্রতিটি নতুন বেতন কাঠামো বা পে-স্কেল নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পেশার মানুষেরই আগ্রহ ছিল। এবারের নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে অন্যান্য পেশার জনগণের মতো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এমপিও ভূক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও আগ্রহ ছিল । এবং তারা জানতেন যে, অন্যান্য বারের মতো এবারও বর্তমান সরকার নতুন বেতন কাঠামোয় এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবও নানা আলাপ আলোচনার ভেতর দিয়ে এমপিও ভূক্ত প্রায় ৫ লাখ শিক্ষকদেরকে যে নতুন বেতন কাঠামোয় অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে তা নিশ্চিত করেছিলেন।

কিন্তু অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সে প্রজ্ঞাপনে দেখা গেল নতুন বেতন কাঠামোয় এমপিও ভূক্ত শিক্ষকদের সম্পর্কে কোন বক্তব্য নেই। এ প্রসংঙ্গে অর্থমন্ত্রী এক বক্তব্যে বলেও ছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোন সুনির্দিষ্ট নীতি মালা না পাওয়ায় এমপিও ভূক্ত শিক্ষকদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত কমিটি নিতে পারেনি।

অষ্টম পে-স্কেল বা নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবিদের মধ্যে আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। দ্বিগুণ বেতন, নববর্ষ উপলক্ষে বোনাস, প্রতিবৎসর ইনক্রিমেন্ট সংযোগ, শিক্ষা ভাতা, স্বাস্থ্যভাতা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে উচ্চ ধাপের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নধাপের কর্মচারীদের মধ্যে যে বিশেষ আনন্দের বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তা প্রজ্ঞাপন জারির সাথে সাথে অধিকাংশ পেশাজীবিদের মুখের হাসি মলিন হয়ে গিয়েছিল। বলা চলে বিলিন হয়ে গিয়েছিল।

বিশেষ করে, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গভীরভাবে হতাশা গ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকারী চাকুরীজীবিদের জন্যে যে অষ্টম বেতন কাঠামো হয়েছে, তার সব সুযোগ সুবিধা এমপিও ভূক্ত শিক্ষকরাও পাবেন।

ওই সময় মন্ত্রী আরো বলেছিলেন, গত জুলাই থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর ধরা হয়েছে। জানুয়ারি মাসেই নতুন বেতন কাঠামো অনুয়ায়ী বেতন পাবেন সবাই। জুলাই থেকে পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনভাতাও পাবেন তারা। এই সংবাদ পাবার পর শিক্ষক-কর্মচারীদের মনে আশা জেগেছিল তারা অষ্টম বেতন স্কেল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না এবং বকেয়াও পাবেন।

৮০ সাল থেকে জারিকৃত প্রতিটি পে-স্কেলে বেসরকারী (এম পি ও ভূক্ত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যদিও এ জন্যে শিক্ষকদেরকে নানা সময় রাজপথে নামতে হয়েছে ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন হাজার হাজার শিক্ষক। অতঃপর নিপিড়িত নির্যাতিত শিক্ষকরা অর্জন করেন ১০০ পার্সেন্ট বেতন।

কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের নিকট থেকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেসরকারী (এমপিওভূক্ত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পাচ্ছেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন থেকে যা অর্জিত হয় তা দিয়েই শিক্ষকদেরকে কিছু ভাতা প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয়। যা উল্লেখ করার মতো নয়।

নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণের লক্ষ্যে ফরাসউদ্দিনের পে কমিশন গঠনের সাথে সাথেই কিন্তু এক দফা মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে দ্রব্য সামগ্রীর উপর। আবার গত এক বছরে নানা কারণে বাজারে কয়েক দফা দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যে বেতন শিক্ষকরা গ্রহণ করছেন তা দিয়ে কোন রকম পেটে ভাতে চলে।

অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে হাত পাততে হয় ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিকট। হাজার হাজার শিক্ষক, সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হয়েছেন ঋণে জর্জরিত। তারপরেও শিক্ষাদানে এসব শিক্ষকরা কাসে যথেষ্ট আন্তরিক। নিয়মিত পরীক্ষা নিচ্ছেন। নিয়মিত নির্বাচনী ডিউটি দিচ্ছেন। অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে সৎ জীবন যাপন করার চেষ্টা করছেন।

এই বৃহৎ শিক্ষক সমাজকে নতুন স্কেলে বেতন ভাতা প্রদান করা হবে বলে শেষমেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তা কবে থেকে বা কোন মাস থেকে দেয়া হবে তা সরকার নিশ্চিত না করায় তারা আজও ভীষণ রকম হতাশ। সর্বশেষ যে একটু আশা করা গিয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী মার্চ-২০১৬ থেকে প্রদান করা হবে কিন্তু পুরনো স্কেলে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন প্রস্তুত করার খবরে পাঁচ লক্ষ বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারী আবারো দারুণ হতাশায় আক্রান্ত হলো এবং আদৌ তারা অষ্টমস্কেলে বেতন পাবেন কিনা তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানারকম সন্দেহ, যে সন্দেহ দূর করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts