বিডি মেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ কিডনি শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এর কোনো সমস্যা হলে যেমন ভয়ের কারণ রয়েছে, তেমনি চিকিৎসার মাধ্যমেও কিডনির রোগ নিরাময় করা সম্ভব। এ বিষয়ে কথা বলেছেন কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরামর্শক অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ।
প্রশ্ন : সাধারণত কিডনির কোন কোন রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে?
উত্তর : কিডনি রোগকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। যেটা হঠাৎ করে কিডনি আক্রান্ত করে তার নাম হলো, একিউট কিডনি রোগ। আর যেটা ধীরে ধীরে কিডনিকে আক্রান্ত করে তাকে বলা হয় ক্রনিক কিডনি রোগ। দুটোই নিরাময় করা সম্ভব। এত ভয়ের ব্যাপারও যেমন থাকে, আশার ব্যাপারও তেমন রয়েছে।
প্রশ্ন : আপনি দুই ধরনের কিডনি রোগের কথা বললেন একিউট ও ক্রনিক। আমি যদি একটু লক্ষণগুলোর কথা জানতে চাই তাহলে দুটোর লক্ষণে কী ভিন্নতা রয়েছে?
উত্তর : একিউট কিডনি রোগটি হঠাৎ করে কিছু বোঝার আগেই হয়ে যায়। কিডনি আমাদের শরীরের আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করে, প্রস্রাবের মাধ্যমে। একিউট কিডনি রোগের প্রধান উপসর্গই হলো প্রস্রাব কমে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে প্রস্রাব কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এর সঙ্গে চোখ বা চোখের পাতার নিচে মুখমণ্ডল ফুলে যেতে পারে। পায়ে পানি আসতে পারে। সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হয়েও যেতে পারে। এটাকে আমরা বলি তাৎক্ষণিক কিডনি রোগের উপসর্গ। এ ছাড়া আপনি হয়তো সুস্থ আছেন, হঠাৎ কোনো কারণে ডায়ারিয়াজনিত রোগ হলো, বারবার বমি করতে থাকলেন। সে ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হলেও একিউট কিডনি রোগ হতে পারে।
এ ছাড়া নারীর ক্ষেত্রে প্রসবকালীন যদি জটিলতা হয়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় বা কমে যায়, ইনফেকশন হয় তাহলেও একিউট কিডনি রোগ বা একিউট কিডনি ফেইলিউর হতে পারে।
এ ছাড়া আমরা তো অনেক সময় জ্বরে ভুগি, চিকিৎসক হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দিল, সে হয়তো জানে না ব্যক্তির সুপ্ত কিডনি রোগ আছে। এই অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে একিউট কিডনি রোগ হতে পারে।
এ ছাড়া কেউ যদি সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, অথবা কোনো অস্ত্রোপচারের পরে যদি রক্তক্ষরণ হয় অথবা হঠাৎ শরীরের কোনো অংশ পুড়ে যায়, যদি ৪০ শতাংশের ওপর পুড়ে যায় তখন একিউট কিডনি ফেইলিউর হতে পারে।
প্রশ্ন : আর ক্রনিকের ক্ষেত্রে…
উত্তর : ক্রনিকের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ আমরা কিডনি রোগ পাই ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ। অথবা উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি রোগ। অথবা নেফ্রাইটিক সিনড্রম যেটা বলি সেই ধরনের কিডনি রোগ। এটাই সাধারণত প্রধান কিডনি রোগ, যা ক্রনিক হয়ে আসে। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয়ই ক্রনিক কিডনি রোগের কারণ হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : ক্রনিক কিডনি রোগের কারণ কী?
উত্তর : যদি ডায়াবেটিস হয় তখন দেখা যায়, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। এই শর্করা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে। এর ফলে কিডনির যে ছাকনি বা ফিল্টারিং পার্টগুলো, দুটো কিডনিতেই তো লাখ লাখ ছাঁকনি রয়েছে, সেগুলো আক্রান্ত হয়। আর এগুলো আক্রান্ত হওয়ার জন্য আমাদের শরীর থেকে যে অ্যালবুমিন এটি নির্গত হয়। যখন থেকে ডায়াবেটিস রোগীর প্রস্রাব দিয়ে অ্যালবুমিন নির্গত হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি তার ডায়াবেটিস থেকে কিডনি রোগ হয়েছে। ঠিক তেমনি উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির যে ছাঁকনি সেখানে চাপ দিয়ে থাকে। এই চাপের কারণে ছাকনির ভেতর রক্তনালিগুলো আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হওয়ার জন্য আবার সেই রক্তনালি দিয়ে অ্যালবুমিন যেতে থাকে। কোনো কিডনি রোগ ধরতে হলে, হয়তো তার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাবে অথবা তার লোহিত কণিকা বা শ্বেতকণিকা যেটা থাকবে সেটা যাবে। সে জন্য আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি বুঝতে পারি অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না এটা দেখে।
প্রশ্ন : একিউট ও ক্রনিক দুটোর প্রতিকার কীভাবে করেন?
উত্তর : যদি একিউট কিডনি রোগ হয় তবে কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা প্রথমেই রোগ নির্ণয় করার জন্য তার রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং ইলেকট্রোলাইটটা করে থাকি। যদি দেখা যায়, ডায়রিয়া এবং বমির জন্য তার একিউট কিডনি রোগ হয়েছে, শরীরে পানিশূন্যতা এসে গেছে তখন স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করি, পটাশিয়াম দিয়ে চিকিৎসা করি। এরপর রক্তচাপ যদি কম থাকে, সেটি স্বাভাবিক করে দিই। এগুলো করলে ব্যক্তি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তার জন্য অবশ্যই তাকে চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। আর পানিশূন্যতা হলে বুঝতে হবে, এটি রোধে কী করবে। গ্রামগঞ্জে থাকলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমরা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট খেতে বলি। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টের সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খেতে বলি। সুতরাং এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের গুরুত্ব যতটুকু, তার তুলনায় ব্যক্তির শরীরে যে পানিস্বল্পতা হয়েছে এটি ঠিক করার গুরুত্ব বেশি। হঠাৎ যদি তার চোখে পানি এসে যায়, প্রস্রাব দিয়ে অ্যালবুমিন বেড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে আমরা রোগীর কিডনি বায়োপসি করে দেখি যে কী ধরনের কিডনি রোগ হচ্ছে। এর যথাযথ চিকিৎসা করলে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। আর বড়দের ক্ষেত্রে বায়োপসির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করি তবে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগী পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। বাকিগুলো ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। সুতরাং এগুলোর ক্ষেত্রে কিডনি অকেজো হওয়ার আশঙ্কা কম।
আর একিউট কিডনি রোগ অন্যান্য যে কারণে হয়, যেমন সার্জারির কারণে যদি হয় সেটা কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে এর পরিমাণ কী রকম হবে সেটা নির্ণয় করে বা অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিয়ে একিউট কিডনি রোগ চিকিৎসা করা হয়।
আর ক্রনিক কিডনি রোগের ক্ষেত্রে আমরা যেটা বলে থাকি, যখনই তার প্রস্রাব দিয়ে মাইক্রো-অ্যালবুমিন যাবে, তখন কিডনির কার্যক্রম সে অবস্থায় স্বাভাবিক থাকে। এই মাইক্রো-অ্যালবুমিনের প্রতিকার করার জন্য বিভিন্ন ওষুধ আজকাল আবিষ্কার করা হয়েছে। সেটা দিলে বৃদ্ধিটা বন্ধ হবে। তাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেই সুস্থ থাকতে হবে। উচ্চ রক্তচাপের জন্যও তাই। এ ছাড়া অবশ্যই ফলোআপে জন্য তিন থেকে ছয় মাস পরপর চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।