শিউল মনজুর
এক.
কবি আযাদ কালামের ৩৫টি কবিতার মলাটবন্দী কবিতার বই, মাতৃদুগ্ধের আকাল পড়েছে দেশে পড়তে পড়তে অভিভূত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি।
যখন কবি বলেন, তুমি চাইলেই অন্ধকার গুহা ত্যাজ্য করে/নক্ষত্রের নরম জ্যোৎস্নায় করতে পারো/ শুদ্ধিস্নান। তখন মনটা ভালো হয়ে যায়। চারপাশের আঁধার পেরিয়ে আশার আলোর দ্যুতি যেনো জ্বলে ওঠে। কবির এমন উচ্চারণ আদর্শিক ও আনন্দময় যেমন, তেমনি কবির প্রতি আগ্রহী পাঠকেরও শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে যায়।
দুই.
বন্ধু, কবি আযাদ কালাম এর এই নতুন বইটিতে এমন নান্দনিক উচ্চারণের বেশ কিছু কবিতা রয়েছে যা পাঠক পড়তে পড়তে কবির মানবতাবোধ, দেশ প্রেম এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার চিত্র অবলোকন করে মুগ্ধ হবেন, ভাবিত হবেন। কবির সাথে মিলেমিশে একাকার হবেন। সেই সাথে কবির বর্ণনা ভঙ্গির মধ্যে সত্য প্রকাশের দৃঢ়তা যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি বর্ণনা ভঙ্গির মধ্যে কাব্যিক সতেজতা বা সজীবতাও অনুভব করা যায়।
এখানে, গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় মানুষের অসভ্যতা শিরোনামের কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করছি;
উদ্ভিদের যৌনাঙ্গ ফুল / ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলে হবে / ফুলের ঘ্রাণে মোহিত হলেও দোষ কি / তাই বলে কারো যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে নেয়ার মতো বর্বরতা / যৌনাঙ্গের পসরা সাজিয়ে লিঙ্গবাজার / না। মানুষ এমন অসভ্য-বর্বর হবে কেন।
তিন.
আযাদের অসংখ্য কবিতায় প্রকৃতির নানা উপাদান লক্ষণীয়। প্রকৃতির এই সব উপাদান বা অনুষঙ্গ কখনো প্রতীকী হয়ে এসেছে কখনো উপমা ও অলংকারের সাজে সজ্জিত হয়ে কবিতাগুলিকে ঝলমলে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
দুটি কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করছি;
এক. রাস্তার দুপাশে অজস্র গুল্ম প্রজাপতির উদ্ভিদ / অযত্নে বেড়ে ওঠে। ওদের কোনো নাম ঠিকানা / গোত্রপরিচয় নেই। অপরিচয়ের কোনো গ্লানিও নেই ওদের। / এসব কারণে বেড়ে ওঠা কিংবা ফুল-ফল-সৌন্দর্যেরও / কমতি নেই । ফুলে-ফলে-পাতায় কতো মনোহর ভঙ্গিমা, /
(কবিতার শিরোনাম; গুল্মপ্রজাপতি, পৃষ্ঠা-২৭)।
দুই. ছানার কাকের খোরাক হবে নিশ্চিত জেনেও / বুলবুলি বারবার বারান্দার বনসাই টবে / গড়ে তোলে শিল্পবাড়ি।
(কবিতার শিরোনাম; অপ্রতিরোধ্য গতির গন্তব্য, পৃষ্ঠা-৩৯)।
চার.
আযাদের কবিতাভাবনাগুলো নিজস্ব ঘরানার হলেও এটা আমাদের মতো হাজারো পাঠকের ভেতরে উচ্চারিত কথারই প্রতিফলন। তার এই কাব্য উচ্চারণগুলো উচ্চকিত না হলেও নম্র নয়, দৃঢ়তায় অনড়। আবেগ নির্ভর নয়, যুক্তি নির্ভর এবং বুননে অনন্য। সেই সাথে তার কবিতাগুলো ধারণ করেছে অতীত, বর্তমান এবং আগামীকালের প্রতিচ্ছবি।
মুগ্ধতা ছড়ানোর মতো আরেকটি কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করছি;
মুরগির ডিম ফুটে বেরোতে চায় খয়েরী ভোর। শাদা কুয়াশা ধুয়ে দেয় বাতাসের ধূলো। মাটির বেটার বেয়াড়া গমনে দুগ্ধবতী হয় রাস্তার ভাসমান। ভূটিবাবুর পশ্চিম সঙ্গমখানায় জরায়ু ভেঙ্গে কেঁদে কেঁদে হেসে উঠতে চায় নোতুন নক্ষত্র। অগ্নিময় আগুনের মুখ লালায় লালায় সিক্ত মাখামাখিতে লাগাতার মায়ের চুমু।
(কবিতার শিরোনাম; মাউথপিস একটি শব্দযন্ত্র, পৃষ্ঠা-৪৩)।
পাঁচ.
সবশেষে, কবিতা পাঠের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আযাদের কবিতা মুক্তপাখির মতন স্বাধীন ও সার্বভৌম। যে কারণে এই গ্রন্থের কবিতা পাঠ করে পাঠকরা নতুন রস আস্বাদন করতে পারবেন বলেই মনে করি।
মোস্তাফিজ কারিগরের সুন্দর প্রচ্ছদে মোড়ানো ৪৮ পৃষ্ঠার এই কবিতার বইটি কাব্যজগতে দীর্ঘদিন টিকে থাকবে বলে প্রত্যাশা করি।
শিউল মনজুর। কবি ও কথাসাহিত্যিক। মেরীল্যান্ড। আমেরিকা। ফোন; ১-৩০১-৫৪৯-৬৯০৪।