মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম, গ্রামের মানুষ ও করণীয়

শিউল মনজুর মূলত গ্রাম নিয়েই বাংলাদেশ। সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের অল্প কয়েকটা জেলা শহর ব্যতীত বাদ বাকী সবই ছিলো গ্রাম আর গ্রাম। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জেলা শহরের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬টি। সে সময়কার থানা সদরগুলো ছিলো পুরোপুরি গ্রামের মতন। এখনকার থানা সদরের মত ঝাক জমক পূর্ণ ছিলো না। কয়েকটি চায়ের দোকান, দু একটি আড়ত আর তরিতরকারী ও মুদি দোকানের সমষ্টি নিয়েই ছিলো থানা সদরের চিত্র। মোট কথা সে সময় অর্থ্যাৎ ১৯৭১ সালের দিকে ১৬টি জেলা শহর ব্যতীত সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিলো গ্রাম আর গ্রাম। স্বাভাবিকভাবে তাই বাংলঅদেশের মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ মানুষের ভূমিকাই ছিলো মুখ্য বা প্রধান।
বাংলাদেশের মুক্তি শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালেল ১৬ ডিসেম্বর লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা লাভ করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযদ্ধের এই ৯ মাসের সংঘর্ষ আমরা নানাভাবে গ্রামীণ মানুষের সম্পৃক্ততা প্রত্যক্ষ করি।
তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকারের পালিত পাঞ্জাবীরা ২৬ মার্চের গভীর রাতে দেশের প্রধান শহরগুলিতে নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর গোলা-বারুদ আর ভারী কামান নিয়ে আক্রমণ চালায়। কেঁপে ওঠে শহরের অলি-গলি। ঘুমন্ত মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। কী হচ্ছে কী হবে কী হতে পারে বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তারপর শহরের অসহায় সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার আশায় ছুটতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে। তখন গ্রামের মানুষ তাদের শহরের ভাইবোনদেরকে টেনে নেয় বুকের গভীরে। পরম আতিথেয়তায় শহরের উদ্ধাস্তু মানুষ গুলোকে জায়গা করে দেয় গ্রামে থাকার। গ্রামের মানুষের এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের সভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে ঘোষনা দিয়ে ছিলেন যার যা আছে তাই নিয়ে তোমরা প্রস্তুত থেকো। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষনের মর্মবাণী-গ্রামের সাধারণ মানুষ গুলোকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিলো। এবং তারাও পশ্চিম পাকিস্তানীদের জঘণ্যতম আক্রমণের জবাব দেবার জন্য চলে যায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানে এই সব গ্রামীণ মানুুষ স্বল্পকালীন ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরে আসে, দেশকে শত্রুমুক্ত করার আশা নিয়ে।

এই সব গ্রামীণ মানুষের নিকট ছিলো না কোন আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু ছিলো সবচেয়ে বড় জিনিষ, যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার যার নাম মানসিক মনোবল। আর ছিলো ট্রেনিং থেকে প্রাপ্ত কৌশল। এই মনোবল আর কৌশলকে অবলম্বন করে কিছু অস্ত্র নিয়ে শুরু করে সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য মনোবল আর কৌশল অবলম্বন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সেনাদের উপর। এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে বেশিরভাগ গ্রামের যুবক শ্রেণী।

অন্যদিকে পাক সেনারা মুক্তিযুদ্ধাদেরকে নির্মুল করার নামে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।  চালায় তাদের হত্যাযজ্ঞ। কিশোরী কিংবা তরুণীদের উপর চালায় অমানবিক অত্যাচার। পাকসেনাদের এই জঘন্যতম কর্মকান্ড এখনও আমাদের স্মৃতিতে দগদগে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
বাংলাদেশের এই মহান মুক্তিযুদ্ধে যুবক ও তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও বালকেরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে। বাড়ির বয়োবৃদ্ধরা ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অন্নের সংস্থান করে দিয়েছে।  গোপনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাশাপাশি বালকেরা পশ্চিমা সেনাদের অবস্থান ও তাদের গতিবিধি ও কার্যকলাপের গোপনীয় তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পৌঁছে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হাজার হাজার মেয়ে তাদের মূল্যবান ইজ্জত হারিয়েছে। তাই তাদের এই ভূমিকা আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে। তাদের এই ভূমিকার কারণেইতো পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় অনেক সহজ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বরেণ্য নেতা তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে যে সরকার গঠিত হয় তা মেহেরপুরের পল্লীতে বসেই হয়। এই অস্থায়ী সরকার পল্লীতে বসেই বিশ্ববাসীকে বাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রযোজনীয়তা ও ইয়াহিয়া সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের অমানবিক চিত্র বিশ্ববাসীকে অবহিত করা হয়। মেহেরপুরে বসেই দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পে জনমত গড়ে তোলা হয়।

এই মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ট তারা আসলে প্রত্যেকেই গ্রামের সন্তান। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ২৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে খুঁজে বের করা হয় এবং তাঁকে বীর প্রতীক উপাধি দেয়া হয়। তিনি ছিলেন এই গ্রামেরই মেয়ে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল শহরে কিন্তু ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। অর্থ্যাৎ গ্রামীণ মানুষের জীবনে। গ্রামীণ মানুষের প্রত্য ও পরো ভূমিকাতেই মুক্তিযুদ্ধের জয় নিশ্চিত হয়েছিলো। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধ ও গ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এই গ্রামের মানুষ আজ অবহেলিত। গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে কারো তেমন চিন্তা ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের মাস্টার প্লান হয় শহরকে নিয়ে। রাজধানীকে নিয়ে। অথচ অবহেলিত হবার পরও আজো গ্রামের মানুষ অতিথি পরায়ন। শহরের মানুষ গ্রামে বেড়াতে গেলে আদর আপ্যায়নের কমতি হয় না।  বড় বড় শিল্প কারখানা তৈরী করা হয়। আর এসব শিল্প কারখানার সস্তা শ্রমিকের মর্যাদা নিয়ে পুজিঁপতিদের উন্নয়নে সাহায্য করে যায় গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাঁদের ভাগ্যের আর উন্নয়ন হয় না।

এখনও গ্রামের মানুষ দেশের প্রতি ভালোবাসায় নিঃস্বার্থ। যে কোন সময় দেশের জন্যে তাদের সবকিছু দিয়ে ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তাই গ্রাম ও গ্রামের মানুষের জন্যে ভাবতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রামকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। স্বাধীনতা যুদ্ধে গ্রাম ও গ্রামের মানুষের ভূমিকা স্মরণ করে তাঁদেরকে সর্বাবস্থায় সম্মান প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে গ্রাম ও গ্রামের মানুষ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্পদ।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts