‘একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?’
‘জ্বি।’
‘তুমি নীলাকে ভালবাসতে না?’
‘বাসতাম। এখনও বাসি।’
‘খুন করলে কেন?’
‘সবই তো বলেছি। কোন কিছু লুকাইনি। এ কারণেই তো আজ আমার ফাঁসি হবে।’
‘তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে। ব্যক্তিগত কারণে।’
‘বলতে ইচ্ছে করছে না।’
‘অ, আচ্ছা।’
কনডেম সেলে জেলর শওকত সাহেব ও আরিফ মুখোমুখি বসে আছেন। আরিফ মাটিতে লেপটে, শওকত সাহেব চেয়ারে। দুজনই চুপ। শওকত সাহেব অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার কেমন লাগছে?’
‘কান্না পাচ্ছে। পৃথিবীটা অনেক নিষ্ঠুর, তাই না?’
‘বাঁচতে ইচ্ছে করছে?’
‘না।’
শওকত সাহেব পায়ের উপর থেকে পা নামিয়ে সামনে ঝুঁকেন।
‘কেন?’
‘নীলার জন্য। ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘নীলাকে তো খুন করে ফেলেছ। তাকে কিভাবে দেখবে।’
আরিফ দাঁড়িয়ে যায়। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ওর বুকে যখন চকচকে ছুড়িটি আমূল বিদ্ধ, তখন শুধু বলল, এ কি হলো আরিফ…এ কি হলো! ঐ মুহূর্ত থেকেই মনে হয়েছে, আমাকে নীলার কাছে থাকতে হবে। ওকে ছাড়া বাঁচব না। আমার হাতের উপর ওর শেষ নিঃশ্বাসটি যখন ফোঁস করে বের হয়ে যায়, তখন আমারও নিঃশ্বাস ওর সাথে মিলে যায়। এই যে….এই আমাকে দেখছেন…এই আমি…আমি না। ফাঁপা, খোলস। এই খোলসটাই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। খোলসটি জলদি ঝুলিয়ে দিন। আহ্…মুক্তি পাব। আপনাদের বিচার প্রক্রিয়া এত দীর্ঘ….সবকিছু স্বীকার করার পরও রায় দিতে তিনটি বছর লেগে গেল।’
‘মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছ না?’
‘ নাহ। এটা অনেক সহজ। জীবনই কঠিন।’
‘একটুও না?’
ডান্ডাবেরির ঝনঝন শব্দতুলে আরিফ শওকত সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘নাহ। টেনশন হচ্ছে, নীলার দেখা যদি না পাই। তাহলে এই জীবন, এই মৃত্যু কেন….কেন…. কেনইবা জীবন পেলাম, কেনইবা মৃত্যু। এর কোনটা না হলে কী হতো! তাহলে তো পৃথিবীও দেখতাম না নীলাকেও জানতাম না, প্রাণে প্রাণে টানও হতো না….খামাখা….আচ্ছা বলেন তো….আমি কি নীলার দেখা পাব?’
‘তুমি আসলেই একটা ভন্ড, ইতর। ভালবাসি, ভালবাসি করে হাহাকার করছ। অথচ ঠান্ডা মাথায় নীলাকে খুন করেছ। তোমার ফাঁসি হওয়াই উচিত।’
‘আমি তো তাই চাইছি। প্লিজ, ডোন্ট কীপ মি ওয়েট। আই ওয়েট এনাফ। ক্যান্ট ওয়েট এনি লংগার। হ্যাঙ মি।’
‘ওহ্, তোমার মতো এমন ভন্ড আমি জীবনেও দেখিনি। মৃত্যুর এমন আকাক্সক্ষা ভন্ডামি ছাড়া কিছু নয়। তোমার আরও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। ডেথ ইজ নট এনাফ।’
‘জেলর সাহেব আপনি আমার অনেক কিছু জানতে চাইছেন না?’
‘চেয়েছিলাম। এখন ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি কিভাবে নীলাকে খুন করলাম, আমাদের প্রেম-ভালবাসার কাহিনী পত্র-পত্রিকায় দেখেননি?’
‘দেখেছি।’
‘ওখানে পুরোপুরি ঘটনা আসেনি। কাল্পনিক গল্পটাই বেশি এসেছে। আপনি শুনতে চাইলে বলতে পারি।’
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘এটা আমার শেষ ইচ্ছা।’
শওকত সাহেব চুপ হয়ে যান।
‘আচ্ছা বলো।’
‘এই দেয়ালটির দিকে তাকান। মনে করেন, এটি একটি সাদা পর্দা। আমি বলব, আপনি পর্দায় দৃশ্যগুলো দেখবেন। ওয়াচ ইট কেয়ারফুল্লি।’
আমার মা যখন মারা যায়, তখন আমার বয়স সাত। বাবা আবার বিয়ে করলেন। মায়ের মৃত্যু, বাবার বিয়ে এর কোনটাই বোঝার মতো বোধ আমার ছিল না।
‘অ্যাম আই রাইট?’
‘ইয়েস।’
আমার বোধ ক্রমেই আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। একটা আলাদা জগত সৃষ্টি হয়। এ জগতে নতুন বাবা প্রবেশ করতেন। আমার নির্বোধ, অবুঝ একাকীত্ব দেখে বাবার অনুতাপের চেহারা আমি বুঝতে পারি। তাকে দেখে মনে হতো, তিনি বলছেন, ‘এ আমি কী করেছি! এ আমি কী করেছি! একদম ঠিক হয়নি! ওর নতুন মায়ের কি দরকার ছিল! আমিই তো ওর বাবা-মা!’ সৎ মায়েরা খুব খারাপ হয়, বড় হয়ে শুনেছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটল। নতুন মা আমাকে পছন্দ করতেন, বুঝতাম। আমি যে তাকে পছন্দ করতাম না, তা নয়…. জড়িয়ে ধরতে চাইতাম….আমার ভেতরের আমিকে বের করতে চাইতাম…পারতাম না। নতুন মা-ই পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরতেন। আসল মাকে ভুলিয়ে দিতেন। নতুন মায়ের মেয়ে ছোট বোনটির চেয়েও বেশি আদর করতেন। আমার ঢুকে যাওয়া মুক ও বধির জগত থেকে আমাকে অতি আহলাদের জগতে বের করে আনেন। আমার যে জন্মধাত্রী মা এবং তার সাথে নতুন মায়ের যে ফারাক, তা ঘুচিয়ে দেন। কাঁচ জোড়া লাগলেও সূক্ষ্ম দাগ থেকে যায়। নতুন মা সেই সূক্ষ্ম দাগটুকুও রাখেননি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যত বন্ধু ছিল, দেখেছি তাদের মায়ের চেয়েও নতুন মায়ের আদর অনেক বেশি। মায়ের এই বাড়াবাড়ি আদর বন্ধুমহলে আমাকে ননীর পুতুল হিসেবে পরিচিত করে তোলে। অনেকে ডাকত ‘বাটার বয়’। নীলা ডাকত ‘ব্লাড অর্কিড’। অতি দুর্লভ ফুল।
নীলার সাথে সম্পর্ক হয় অনার্স থার্ড ইয়ারে। ওর বাবা রহমত বাবুর্চি। ফুল বাবুর্চি নন। হেড বাবুর্চির সহকারী। পুরনো ঢাকার হাজারীবাগে সুতোর মতো প্যাঁচিয়ে থাকা অসংখ্য সরুগলির মাঝখানে এক রুমের ছোট্ট একটি বাসায় তার বসবাস। একবার ঢুকলে গোলক ধাঁধাঁর চক্করে পড়তে হয়। যেখান থেকে শুরু, ঘুরেফিরে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে সেখানেই ফিরতে হয়। ভালোমতো নিশানা না রাখলে বের হওয়া অসম্ভব। বাসাগুলোর একটির সাথে আরেকটির আন্তঃসংযোগ রয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে, থকথকে কাদাময় পথে এক বাসার ভেতর দিয়ে আরেক বাসায় যেতে হয়। বলা যায়, পুরো এলাকাটি একটি বাসা। এই এলাকায় নীলা নীলপদ্ম হয়ে ফুটে আছে। একমাত্র পদ্মফুলটিকে অতি আদরে-েযত্নে রহমত বাবুর্চি আগলে রেখেছেন। তার যত্নে জীবন উৎসর্গ করেছেন। জীবনের শখ ও স্বপ্ন তাকে ঘিরে। নীলার মধ্যে পরিবেশ প্রতিবেশের লেশমাত্র প্রভাব নেই। যেন অন্ধকার ও কুয়াশা থেকে বের হয়ে আসা কোন আলো। কথাবার্তা, চালচলনে আভিজাত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত।
‘আপনি কি শুনছেন?’
‘শুনছি।’
নীলা রাখঢাকের ধার ধারে না। সংবেদনশীল কথা প্রকাশে করতে মেয়েদের সামনে যে দ্বিধার দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে, নীলার মধ্যে তা ছিল না। সবকিছু অকপটে বলে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরিফ, তোমাকে যে আমি ভালবাসি, তুমি কি জান?’ আমি বললাম,
‘এই মেয়ে তোমার কি লাজলজ্জা নেই? বুক ফাটার আগেই মুখ ফেটেছে? কোন মেয়ে কি এভাবে বলে?’
নীলা হাসতে হাসতে বলে,
‘ভালবাসাকে বুকে চেপে কষ্ট দিয়ে লাভ কি! ভালবাসাকে চেপে রাখার কোন মানে হয় না। একে যতœ করতে হয়। আদর করতে হয়। প্রকাশ করতে হয়। আমি আমার ভালবাসাকে কষ্ট দিতে চাইনা। আমার ভালবাসা তোমাকে চেয়েছে, তার চাওয়া পূরণ করেছি।’
‘তোমার ভালবাসার এই চাওয়া যদি পূরণ না হয়!’
‘না হলেও সমস্যা নেই। আর আমি এমন কারও কাছে আমার ভালবাসা প্রকাশ করিনি যে, তা ভেসে যাবে। আমি জানি, আমার ভালবাসা যাকে চেয়েছে, সে তা ফেরাতে পারবে না। নীলপদ্মকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। বলো তুমি পারতে?’
‘অ্যাই…অ্যাই…তুমি এত কথা কোত্থেকে শিখেছ?’
‘আমার ভালবাসাকে নিরাপদ করতে যা যা করার প্রয়োজন আমি তাই করেছি। তুমিও তো তাই করতে, তাই না?’
নীলার ভালবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। পৃথিবীর আর কেউ পারত কিনা জানি না। কোন কথা খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আচ্ছা, এই চৈত্রের দুপুরে, খটখটে পরিবেশেই তুমি ভালবাসার কথা বললে! একটু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করলে না!’
নীলা আমার বুকে ডান হাতটি রাখে।
‘কেন, তোমার ভাল লাগছে না? খুব তপ্ত মনে হচ্ছে?’
‘তুমি পারও এবং পেরেছও।’
‘আমি জানি, আমি পারব।’
আরিফের চোখ দিয়ে পানি ঝরে। অনুভূতিহীন গাছের ক্ষতস্থান থেকে কষ বের হওয়ার মতো। প্রতিক্রিয়াহীন। দেয়াল থেকে মুখ ঘুরিয়ে জেলর সাহেবের দিকে তাকায়।
‘আপনি কি শুনছেন?’
জেলর সাহেবও ভাবলেশহীন ভাবে আরিফের দিকে তাকায়।
‘শুনছি।’
‘কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি।’
‘গল্পটা কেমন?’
‘গতানুগতিক। সাধারণ।’
‘এটা সাধারণও নয়। অসাধারণও নয়। এই ভালবাসা বর্ণনার কোন শব্দ নেই।’
‘হতে পারে।’
আরিফ বলতে শুরু করে।
‘সাধারণ ভালবাসার মতোই আমাদের চলা শুরু। ঘোরাফেরা, ডেটিং। নীলাকে বললাম, ‘বিয়ে করব।’ নীলা নিঃসংকোচে বলল,
‘নিশ্চয়ই। আমার ভালবাসা তো এতিম হতে পারে না। অন্য কোথাও বসবাস করতে পারবে না। তার আগে আমাকে….আমার ভালবাসাকে….আমার বাবা যেভাবে আগলে রেখেছেন, তাকে তো বলতে হবে।’
শওকত সাহেব আরিফকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘নীলার বাবার কাছে তুমিই গেলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার বাবা-মাকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করনি কেন?’
‘বাবা তার অনুশোচনা শোচন করার জন্য কখনোই আমার কোন কিছুতে বাঁধ সাধেননি। জানতাম আমার বিয়ের মাধ্যমে তার দীর্ঘ শোচনার অবসান হবে। বাবার অনুশোচনাকে শোচন করার জন্য মায়ের চেষ্টারও অবসান হবে। কাজেই…।’
‘নীলার বাবা কি বললেন?’
‘তিনি কিছুক্ষণ কাঁদলেন। পরনের চিটচিটে হলদেটে দাগ লাগা ময়লা লুঙ্গিতে চোখ মুছে মাথা তুলে বললেন, কখনও হেড বাবুর্চি হতে পারিনি। হেড বাবুর্চি হয়ে রিটার্য়াড করার সুযোগটি কি আমাকে দেবেন?’
‘নিশ্চয়ই। আপনার মেয়ের বিয়ের রান্না আপনিই করবেন।’
বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। নীলার খুশি চোখে পড়ার মতো। ছোট আকারে নাচগানের আয়োজন ছিল। বিয়ের আসর থেকে উঠে নীলাও নাচতে শুরু করে। পরম আদরে মা ও বাবা নীলাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের আলিশান বাড়িতে নিয়ে আসে। এতদিনে মনে হলো, নীলপদ্মের জায়গা এটাই। তবে হেড বাবুর্চি হিসেবে নীলার বাবা ফেল করেছিলেন। অতিথিদের বেশিরভাগই বলছিল, রেজালায় বেশি লবন হয়েছিল। মুখে দেয়া যায়নি। আমি বুঝেছিলাম, ওটা লবন নয়, রহমত বাবুর্চির চোখের নোনা জল।
‘জেলর সাহেব!’
‘হু।’
‘গল্পটা কেমন?’
‘পুরোটা শোনার পর বলব।’
নীলার ভালবাসার শক্তি প্রবল। স্রোত ও গতি অনেক বেশি। কেবল ভেসেই যাচ্ছিলাম। আমার এই ভেসে যাওয়া দেখে বাবাকে সুখী মনে হচ্ছিল। মা যেন খুব একটা সুখী হতে পারছিলেন না। আগে সকালে মাথার কাছে চায়ের কাপ হাতে মা দাঁড়িয়ে থাকতেন। চোখ খুলে দেখতাম মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছেন। এখন একদিন নীলাকে, একদিন মাকে দেখতে পাই। যেদিন মাকে দেখতাম, সেদিন রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত, ‘তুমি যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।’ বুঝতাম, মায়ের ভালবাসায় নীলার ভাগ বসানোটা পছন্দ হচ্ছে না। দু’জনের মধ্যে ভালবাসার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ভালই লাগত। মাঝে মাঝে শুনতাম মা বলছেন, ‘বউ মা, তোমার এত কাজ করা লাগবে না। তুমি যাও।’ বুঝলাম, সংসারেও নীলার ভাগ বসানোটা মা’র পছন্দ হচ্ছে না। আফটার অল, এতদিনের সংসার….নতুন কেউ এসে তা দখল করবে….এটা কে দিতে চায়। আবার সংসার করতে এসে, সংসার করতে কোন মেয়ে না চায়। মা ও নীলার মধ্যে সংসার ও আমার প্রতি ভালবাসার দখলদারিত্ব নিয়ে ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে। একদিন সকালে নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম। দোকানপাট সবে খুলতে শুরু করেছে। দোকানিরা দোকান খোলার সময় ক্যাসেটে বাংলা তরজমাসহ কোরআন তেলওয়াত বাজাচ্ছে। হিন্দুরা ধূপধূনা দিয়ে দোকান খুলছে। সেদিন তরজমাসহ কোরআনের একটি আয়াত মনে ধরল। ‘ফাবিআইয়ে আলা ই রাব্বিকু মা তুকাজ্জিবান- আল্লাহর কোন নেয়ামতকে তুমি অস্বীকার করবে।’ মা ও নীলার এই যে ভালবাসা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার এটাও মনে হলো- রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান এসবও তো আল্লাহর নেয়ামত। এগুলোরও প্রয়োজন রয়েছে। এগুলো ছাড়া তো মানুষ হয় না। তবে এর পরিমাপ থাকতে হয়। বাড়াবাড়ি উচিত নয়। অতি রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান যেমন ভাল নয়, অতি ভালবাসাও ভাল নয়। বুকটা কেঁপে ওঠে।
‘জেলর সাহেব!’
‘বলো।’
‘গল্পটা কি শুনছেন?’
‘শুনছি।’
‘গল্পটা এখানেই শেষ।’
শওকত সাহেব চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠেন।
‘না….এখানেই শেষ নয়। তুমি শেষটা বলোনি।’
‘শেষটা আপনি জানেন।’
‘জানি। তারপরও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
‘শেষটা আমার ফাঁসি।’
‘তা জানি। তারপরও শেষ হয়েও হচ্ছে না।’
আরিফ হা হা করে হেসে উঠে। ফাঁপা চোঙা থেকে বের হওয়া শব্দের মতো। নিষ্প্রাণ। শওকত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মাথা নিচু করে বসে থাকেন। আরিফ হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে। দু’হাতে শওকত সাহেবকে ঠেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসায়।
‘আপনার চোখে পানি কেন?’
‘জানি না। আমাদের সব ইন্দ্রিয় সবসময় সমানভাবে কাজ করে না। নিয়ন্ত্রণেও থাকে না।’
‘তা ঠিক। নিয়ন্ত্রণে থাকে না। থাকলে এই গল্পের সৃষ্টি হতো না।’ আরিফ ধীরে ধীরে দেয়ালের কাছে যায়। দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে শওকত সাহেবের দিকে তাকায়। শওকত সাহেব কেঁপে কেঁপে উঠছেন। আরিফ অস্ফুট স্বরে বলে,
‘গল্পটার শেষ অংশ খুব ছোট। একদিন সকালে রান্না ঘর থেকে নীলা ও মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙ্গে। খুব বেশি রকমের চেঁচামেচি। তড়িঘড়ি ছুটে গেলাম। মা নীলাকে বলছে, ‘শাট আপ, এটা আমার সংসার! আমি যেভাবে চালাব সেভাবেই চলবে।’ নীলাও জবাব দেয়, ‘এখন এটা আমার সংসার। আমি এ বাড়ির একমাত্র বউ।’ মা বললেন, ‘তুমি সংসারের কি দেখেছ। এসেছো তো…।’ নীলা বলল, ‘ইউ শাট আপ! আপনিও কোথা থেকে এসেছেন, জানি।’ আমার মাথা গরম হয়ে গেল। বললাম, ‘তোমরা কি শুরু করেছ!’ নীলা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুমি চুপ থাক।’ মা আরও উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুমি আমার ছেলেকে ধমক দিচ্ছ! তোমার এত বড় সাহস!’ বলেই এক চিৎকার দিলেন। আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম। গল্পটা এখানেই শেষ।’
শওকত সাহেব মাথা তুলে বসেন। স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করেন,
‘তোমার বাবা কোথায় ছিলেন?’
‘জরুরী কাজে ভোরেই বের হয়ে যান। আর ছোট বোনটি আগেই পড়াশোনা করতে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল।’
‘জেলর সাহেব….এখন কয়টা বাজে?’
‘আটটা।’
‘ওহ্….আরও অনেক সময়….মনে হচ্ছে অনন্তকাল আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।’
দু’হাত উপরে তুলে আরিফ বলল,
‘ও লর্ড….হোয়াট ওয়াজ মাই ফল্ট? হোয়াই ইউ সেন্ট মি অন আর্থ? ইফ নট, ইট ম্যাটারস নাথিং টু ইউ। নাউ হোয়াট? ইউ সেন্ট মি অ্যান্ড আই ফেইল….সো ইউ।’
শওকত সাহেব চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যান। উত্তেজিত হয়ে বলেন,
‘শাট আপ! ইউ ফিলদি ক্রিয়েচার! ইট ইজ নট ইউ। ইট ইজ মি। মাই ফেইলরিটি।’
‘ড্যাড! ইট ইজ নট ইওর ফেইলরিটি। ইউ ট্রাইড বেস্ট। ইউ আর দ্য বেস্ট এভার ফাদার ইন দ্য ওর্য়াল্ড। অ্যান্ড আই অ্যাম দ্য ওয়ার্স্ট এভার সান অফ এ বেস্ট ফাদার।’
শওকত সাহেব আরিফকে জড়িয়ে ধরেন। কাঁদতে থাকেন।
‘কেন তুই এ কাজ করলি, বাবা….কেন? আমি কেন তোকে সেভ করলাম না। আমি তো পারতাম। কেন করলাম না?’
আরিফ শওকত সাহেবকে ছাড়িয়ে দু’হাতে তার চোখের পানি মুছে দেয়।
‘ড্যাড, তুমি যা করেছ….ঠিক করেছ। ইউ আর দ্য ম্যান। ক্যান্ট কম্প্রমাইজ এনিথিং ইললিগ্যাল। আনলেস, ইউ ক্যান্ট বি দ্য বেস্ট ফাদার।’
শওকত সাহেব শক্ত হয়ে দাঁড়ান।
‘ইয়েস, মাই বয়। আই কুডন্ট বি দ্য বেস্ট ফাদার অফ এ সান লাইক ইউ। কেউ হয়ত জানবে না। ডাজনট ম্যাটার, বাট মাইটি আল্লাহ নৌজ বেটার।’
‘বাবা!’
‘হু।’
‘চলো। সময় হয়ে গেছে।’
ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। আরিফকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শওকত সাহেব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেঙ্গে পড়তে পড়তেও পড়ছেন না। শওকত সাহেবের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আরিফ দাঁড়ায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘বাবা, আমি নীলাকে খুন করিনি। মা করেছে।’ বলেই, ‘আল্লাহর কোন নেয়ামতকে তুমি অস্বীকার করবে’ বলে ফাঁসির মঞ্চে উঠে।
শওকত সাহেব আরও শক্ত হয়ে যান।
অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, গো এহেড মাই বয়….গো এহেড। ডোন্ট গো ফার এওয়ে।#
কামরুল হাসান দর্পণ এর গল্প