এই ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জীবনের আশি বছর পূর্ণ হলো। এতদিনে নিজেকে বিজ্ঞ বলে দাবি করার সুযোগ পাওয়া গেল।
সত্তর বছর বয়স্ক লোকের শোক-সংবাদ পড়ি কাগজে: বার্ধক্যজনিত রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আমি তো আশি পেরোলাম, আমার ক্ষেত্রে কী বলা হবে? অতিবার্ধক্যজনিত? অথচ নিজেকে আমি বৃদ্ধ ভাবতে পারি না। জীবনতৃষ্ণার দিক দিয়ে আমি এখনো তরুণ, তবে আধুনিক প্রযুক্তির সামনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারি, আমি মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য।
বহুকাল আগে একটি রুশ একাঙ্কিকার বাংলা ভাষ্য রচনা করেছিলাম। তাতে নায়ক এক জায়গায় দৃপ্ত কণ্ঠে বলছে, ‘শুধু দীর্ঘজীবনের কোনো বিশেষত্ব নেই যদি না জীবনে চমৎকারিত্ব থাকে।’ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসে সে-ই আবার বলেছিল, ‘বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে!’ আট দশক ধরে আমি যে সেই আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছি, তা আমার পরম সৌভাগ্য।
নিজের সুদীর্ঘ জীবনের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন দেখি কতজনের কাছে সে জীবন ঋণে ভরা। প্রত্যেক মানুষেরই প্রথম ঋণ পিতামাতার কাছে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। নিজের জীবনের উদাহরণ নিয়ে আব্বা আমাকে সময়ানুবর্তিতা শিখিয়েছিলেন। মা শিখিয়েছিল সত্যানুবর্তিতা। জীবনে যে এ দুয়ের ব্যত্যয় করিনি, এমন কথা বললে মায়ের শিক্ষাকে অপমান করা হবে। দেশ ও ভাষার প্রতি মায়ের ছিল বিশেষ অনুরাগ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ও আমার এক দঙ্গল বন্ধুকে পেট ভরে খাইয়ে মা রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছিল, জানতে চেয়েছিল, আমাদের কাউকে পুলিশ ধরলে কী করতে হবে। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার গড়ে উঠলে আব্বাকে নিয়ে মা সেখানে গিয়েছিল এবং আমার মৃত এক ছোটো বোনের স্মারকস্বরূপ যে-সোনার হারটি তার কাছে সঞ্চিত ছিল, শহীদ মিনারে তা নিবেদন করে এসেছিল।
ভাষা-আন্দোলনের অল্পকাল পরে আমি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি। সে সংযোগ বছর পাঁচেকের বেশি স্থায়ী হয়নি। তবে ওই সময়ে বামপন্থার যে শিক্ষা লাভ করেছিলাম, তা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালের জন্যে গঠন করে দিয়েছিল। ওই শিক্ষা না পেলে আমি আজকের আমি হতে পারতাম না।
জগন্নাথ কলেজে অজিতকুমার গুহ ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কাছ থেকে প্রথম পেয়েছিলাম রবীন্দ্র-সাহিত্যের শৃঙ্খলাবদ্ধ পাঠ। নারায়ণচন্দ্র সাহা জাগিয়েছিলেন ইতিহাসে আগ্রহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র স্নেহ ও উৎসাহ পেয়েছি। মুহম্মদ আবদুল হাই দিয়েছিলেন গবেষণার প্রবর্তনা। মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যরুচি ও জীবনবোধ আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর যাঁর শ্রেণিকক্ষের ছাত্র না হয়েও তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডারের অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ হয়েছি, তিনি আব্দুর রাজ্জাক। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের প্রীতি ও শুভেচ্ছা আমাকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছে।
আমার বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে আনোয়ার আবদেল-মালেকের কথা বিশেষ করে বলতে চাই। পাঁচ বছর ধরে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে পৃথিবীর নানা দেশে যাওয়ার ও নানা বিষয়ের পণ্ডিতদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং আমার নিজের বিদ্যায়তনিক শৃঙ্খলার বাইরে অনুশীলন করার প্রেরণা দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে আরো দুটি কথা বলি। আমি একবার তিন মাস প্যারিসে থেকে তাঁর সঙ্গে মিলে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। বয়োজ্যেষ্ঠ বলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম আগে দিয়েছিলাম, নিজের নাম পরে। বইটা যখন লন্ডনে ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশ পেল, তখন দেখলাম, আমার নাম প্রথমে, আনোয়ার আবদেল-মালেকের নাম শেষে। জামাল আবদেল নাসেরের শাসনকালে আনোয়ার আবদেল-মালেক মিশর ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যেতে বাধ্য হন। প্যারিসে তাঁর ড্রইংরুমে প্রথম ঢুকে দেখলাম, ম্যান্টেলপিসের ওপরে নাসেরের প্রতিকৃতি বাঁধিয়ে রাখা। আমি আনোয়ারকে বললাম, নাসের না আপনাকে দেশছাড়া করেছেন? তিনি বললেন, নাসের আমার প্রতি অন্যায় করেছেন; কিন্তু তিনি দেশের জন্যে যা করেছেন, কোনো মিশরীয় তা কখনো ভুলতে পারবে না। এমন মানুষের সাহচর্যও চিত্তবৃত্তির প্রসার না ঘটিয়ে পারে না।
আগের কথায় ফিরে যাই। আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও যে আমি কিছু শিখিনি, তা নয়। তবে তাদের নিরন্তর ভালোবাসা এবং আমার অধিকাংশ সহকর্মীর সমর্থন আমার শিক্ষকজীবনের চলার পথ সুগম করেছে। আমার সন্তানেরা কখনো আমার সাধ্যাতীত কিছুর দাবি জানিয়ে আমাকে বিব্রত করেনি। পারিবারিক জীবনের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রী আমাকে নিজের মতো চলার ও কাজ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। তারপরও আমার যতটা করার ছিল, আমি তা করতে পারিনি। জীবনের শেষদিকে এসে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আফসোস করতেন, ‘আপনি তো আর লেখাপড়া করলেন না!’ তাঁর মতো মানুষের প্রত্যাশা যে আমি পূরণ করতে পারিনি, তা আমার জন্যেও দুঃখের বিষয়। ভেবে দেখেছি, আশানুরূপ কিছু করতে না পারার তিনটে কারণ আছে আমার। সামাজিক অঙ্গীকারপূরণের চেষ্টা, আমার স্বাভাবিক আলস্য এবং অস্বাভাবিক আড্ডাপ্রিয়তা। সামাজিক কর্তব্যবোধ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেজন্যে সময় দেওয়াটা আমি কখনোই সময়ের অপচয় মনে করতে পারিনে। নিজের আলস্য অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য। আমার বন্ধুচক্র বিশাল: তাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার জীবনের প্রশান্তির একটা বড়ো উৎস। তাই যদি বলি, কোনো খেদ নেই, তাহলে মিথ্যে বলা হবে না।
আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম—সেক্ষেত্রে প্রাপ্যের অধিক লাভ করেছি। আমি সারাজীবন ছাত্র থাকতে চেয়েছিলাম—আমার যথাসাধ্য শিখতে চেষ্টা করেছি। জীবনে চলার পথে অপ্রত্যাশিত আঘাত যে পাইনি, তা নয়, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার খেদ থাকার কথা নয়।
তারপরও খেদের কথা একটু বলি। বাংলা একাডেমির পরিকল্পিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা—এটি অবশ্য আমার একার ওপর নির্ভর করে না—এবং আমার কয়েক দশকের পরিকল্পিত পুরোনো বাংলা গদ্য-সংকলনের কাজ যদি শেষ করে না যেতে পারি, তাহলে আমার দুঃখ রয়ে যাবে।
যাঁরা আজকের এই অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তাঁদের সকলকে, বিশেষ করে, উদ্যাপন-কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের, চন্দ্রাবতী একাডেমী এবং এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক-প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। এই সভার সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, বক্তাদের সহৃদয়তার জন্য, সঙ্গীতশিল্পীদের অংশগ্রহণের জন্য, সঞ্চালককে তাঁর দায়িত্বপালনের জন্য এবং আপনারা যাঁরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের পূর্ণতা সাধন করেছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ। শিশু-শিল্পীদের ভালোবাসা। আজ যে বইটি প্রকাশ পেল, তার সম্পাদক, লেখক ও প্রকাশকের কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম। আমার নিন্দুকেরা যদি একটি রচনা-সংকলনের সময় ও সুযোগ পেতেন, তবে আমার পরিচয় সম্পূর্ণ হতো।
এখন আমার আর কী চাইবার আছে! আসলে মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। আমি চাইব, আপনাদের ভালোবাসা যেন আমার বাকি দিনগুলো ঘিরে রাখে।
বাংলাদেশের মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করিনি। তবে এই মাটিই যেন আমার শেষ আশ্রয় হয়, এই আমার অন্তিম প্রার্থনা।
## ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ৮০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে চন্দ্রাবতী একাডেমী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে তিনি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। পাঠকের জন্য সেই বক্তব্যটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো।