শান্তা মারিয়া
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন চীনের গ্রামের মানুষ সত্যিই কেমন আছেন? আমি বেশ কয়েকটি চীনা গ্রাম দেখেছি। প্রথমেই বলি বেইজিংয়ের উপকণ্ঠের একটি গ্রামের কথা।
শিজিংশানে আমার বাসভবনের কাছেই ছিল কালো পাথরের গ্রাম। আর ছিল তুংশান। মানে মাউনটেনিয়ারিং ক্যাম্প। দুটোই পশ্চিম পাহাড় মানে ওয়েস্টার্ন হিলসে। পাহাড় আমার এমনিতেই দারুণ প্রিয়। সিআরআই বাসভবনে আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেত লাওশান বাবাওশান টিলা। কি যে ভালো লাগত সেদিকে চেয়ে থাকতে।
কালো পাথরের গ্রাম বেইজিংয়ের পশ্চিমদিকের উপকণ্ঠে। বাসে চড়ে তিন/চার ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম ।
এখানে রয়েছে বসতি, চারণভূমি, চাষের জমি। সত্যিকারের এক চীনা গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর। এক বৃদ্ধকে দেখতাম ছাগল চড়াতে। ছোট্ট একটি নালার মতো ছিল। বসন্তে সেখান দিয়ে বয়ে যেত বরফগলা পানি।কালো পাথরের গ্রাম আবিষ্কারের গল্পটাও মজার।
আমার বাসার কাছের বাস স্টপেজে দাঁড়ালে প্রায়ই দেখতাম একটা বাস পশ্চিমে যায়। কতদূর যায় এই বাস? জানার খুব কৌতুহল হতো। একদিন চেপে বসলাম ওই বাসে। দেখি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ক্রমে সেটা শহর ছাড়িয়ে গেল। পাহাড়ের কোলে এসে থামল বাসটা। শেষ স্টপেজে নেমে বুঝতে পারলাম গ্রামে এসে পড়েছি। নামলাম তো বাস থেকে শেষ যাত্রী। বাসটা ঢুকে পড়লো ডিপোতে।তার মানে এটা এখন আর যাবে না।তখন বিকেল। ফিরতি বাস কোথা থেকে ছাড়ে বুঝতে পারছি না। হাঁটা ধরলাম শহরের দিকে। জনমনিষ্যি নেই যে পথের দিশা জিজ্ঞাসা করব।হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটার পথ এসে তবে ফিরতি স্টপেজের দেখা পেয়েছিলাম সেদিন। ভারি ভালো লাগছিল পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে আসতে। সেদিনের পর থেকেই কালো পাথরের গ্রাম প্রিয় জায়গা হয়ে গিয়েছিল। শীত, গ্রীষ্ম আর শরতে এর রূপ পাল্টে যেত। ঠিক একই জায়গায় তিন ঋতুতে ছবি তুলে দেখেছি কিভাবে পাল্টে যায় প্রকৃতির রূপ।
তুংশানে ছিল আপেল বাগান। ফিংগুইউয়ান। এই সব আপেল বাগানে গাছে গাছে আপেল ধরে থাকতে দেখে অবাক হতাম। তেমন কোনো পাহারা বা মানুষজন চোখে পড়তো না। অথচ চুরি হচ্ছে না কিছুই। বিকেলে দেখা যেত বাস থেকে নামছে শিশুকিশোররা। ওরা ফিরছে স্কুল থেকে।চারিদিকে শান্তিময় জীবনের ছবি। চীনা গ্রাম এবং গ্রামের মানুষদের সঙ্গে টুকটাক কিছু আলাপ হয়েছে এবং দেখেছিও কয়েকটা গ্রাম। মানুষজন কিন্তু সত্যিই বেশ শান্তিতে আছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তরুণরা কাজে আর বৃদ্ধরা উপভোগ করছে অবসর। অবকাঠামোগতভাবেও গ্রামগুলো উন্নত।পাশ্চাত্যের হাজারো প্রচারণা আছে চীনের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি সেটা যথেষ্ট ইতিবাচক। সন্ত্রাস, খুন ইত্যাদি অপরাধ নাই বললেই চলে। সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থাও যে যথেষ্ট ভালো সেটা তাদের কাপড়চোপড় আর খাবারের বহর দেখলেই বোঝা যায়। কৃষকরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।ফলে শস্যের উৎপাদন প্রচুর। বাজারে খাদ্য সামগ্রীর বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। নিত্যপণ্যের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই্।
আরেকটা উপকণ্ঠেও যেতাম। সেখানে গ্রামের মধ্যে ছোট্ট একটা পার্ক আর টিলা ছিল। সেই সবুজ টিলায় উঠে বসে থাকতাম। পুরো টিলা ভরে যেত ছোট ছোট হলুদ ফুলে। ইংছুনহুয়া ফুল। এই ফুল বসন্তের দূত। বসন্তের প্রকৃতি দেখতাম দুচোখ মেলে।সেই পার্কে গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যায় নাচের আসর বসতো। সেই আসরে অনেকবার অংশ নিয়েছি।
উপকণ্ঠে কখনো গেলে ওখানেই কোনো রেস্টুরেন্টে বরবটি ভাজা খেয়ে নিতাম।
ইউননান ও অন্যান্য প্রদেশের গ্রামও দেখেছি। চীনের মানুষ খুব পরিশ্রমী। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফসল ফলান, গবাদি পশুর খামার রয়েছে। গ্রামের শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। শিক্ষা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। বৃদ্ধরা হালকা গৃহস্থালি কাজ করেন। চাষের জমিতে কর্মক্ষম নারী পুরুষরা শ্রম দেন। শিশুশ্রম আমি দেখিনি। কোন বৃদ্ধকেও খুব কঠোর শ্রম করতে দেখিনি।
বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িঘর উন্নত। কমিউনিটি সেন্টার আছে। আছে লাইব্রেরি। অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ইনডোর ও আউটডোর গেমসের ব্যবস্থাও আছে। ইন্টারনেট আছে। আছে কম্পিউটার।
সত্যি বলতে কি জনগণ যে শান্তিতে আছে সেটা তাদের চেহারাতেই লেখা রয়েছে। কারণ পরিতৃপ্তি, সন্তুষ্টির একটা আলাদা বডি ল্যাংগুয়েজ আছে যেটা চীনের মানুষজন দেখলেই বোঝা যায়।
মনে মনে ভাবি এমনি কোনো চীনা গ্রামে নির্জন সবুজ পাহাড়ের কোলে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।
শান্তা মারিয়া: কবি, লেখক, চীন প্রবাসী