বাঙালিদের প্রাণের উৎসব ॥ শিউল মনজুর

প্রিয় ঋতু বসন্ত বিদায় নিয়েছে। নতুন বছরের নতুন মাস বৈশাখ এবং গ্রীস্ম ঋতু আমাদের প্রকৃতির দরজায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য ইতোমধ্যে বৈশাখ তার আগমণবার্তা জানান দিয়েছে আমাদের জীবনে। চৈত্রের শেষদিকে এসে বৈশাখি তান্ডব বয়ে গেছে দেশের নানা জায়গায়।

তুমুল ঝড় ও বৃষ্টির কারণে ভেঙ্গে পড়েছে হাজারো মাটির ঘরবাড়ি, উড়ে গেছে হাজারো ঘরের টিনের চালা। গৃহহীন হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কৃষকেরাও হয়েছে নিঃস্ব। নানা জায়গায় ঝড় ও বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে বোরো ধান। শিলাবৃষ্টিও হয়েছে অসংখ্য জায়গায়। সেই সাথে বজ্রপাতে নিহত হবার খবরও এসেছে কাগজে ও অনলাইনে। আসলে এগুলিই হচ্ছে বৈশাখি রুদ্ররূপ।

sssssssss

হয়তো বৈশাখ মাসের সামনের দিনগুলিতে এই রুদ্ররূপ আমরা আরো কমবেশি প্রত্যক্ষ করবো। তারপরেও নতুন বছর নতুন মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নতুন আশায় নতুন প্রত্যাশায় রঙে রঙে উৎসবে আমরা বাঙালিরা বরণ কর নেব।

এই বরণ উৎসব অনন্য এক উৎসব। কেননা এ উৎসব কোন নির্দিষ্ট ধর্মালম্বী মানুষের উৎসব নয়। এ উৎসব সকল বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। বাঙলা নববর্ষকে বরণ করে নেবার উৎসব। তাই বৈশাখের প্রথমদিন বাংলাদেশের ঘরে-বাইরে, আনাচে কানাচে সর্বত্র উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে।

যে উৎসব ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তের সীমা পেরিয়ে একাকার হয়ে যায়। তাই পহেলা বৈশাখে উৎসব পালন আমাদের জাতীয় জীবনে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। রূপ নিয়েছে সর্বজনীন উৎসবে।

বাঙালিদের প্রিয় বর্ষ বরণের এই উৎসব কিন্তু শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। কথিত আছে যে মোগল সম্রাট আকবর এর আমল থেকে বাঙলা সন চালু হয়েছে। খাজনা বা কর আদায়ের সুবিধার্থে এবং তৎকালীন সময়ে হিজরি সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ ৩৬৫দিন বছর গণনা করে বাংলা সন চালু করেন।

আরো একটি তথ্যে জানা যায়, ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে এ কে বজলুল হক বাংলা নববর্ষে পহেলা বৈশাখ ছুটি ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তাই বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসব ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে বহুদিনের পুরনো। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বাংলা সনের বর্ষবরণ উৎসব গ্রাম বাংলার প্রাচীন একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। বর্তমানে নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এই উৎসবটি পালন করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছায়ানট বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান রমনার বটতলায় করে থাকে।

অন্যান্য বছরের মতো বর্ষবরণকে সামনে রেখে এদিন রাজধানীর সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বটতলায় সমবেত হবে এবং পহেলা বৈশাখের সুচনালগ্নে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান, এসো হে বৈশাখ, এসো হে… গেয়ে গেয়ে সমবেত দর্শক শ্রোতা বরণ করে নেবে নতুন বছরকে।

গানের সুরে সুরে বটতলায় আবেগ আপ্লুত লক্ষপ্রাণ বাঙালি উপভোগ করে বর্ষবরণ উৎসব। আবার চারুকলা থেকে যথা নিয়মে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। উৎসবকে রাঙিয়ে তুলতে এবং অতীত ঐতিহ্যকে স্মরণ করে প্রতিবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়।

এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও নানা পেশার মানুষ নানা বয়সের মানুষ অংশ গ্রহণ করে থাকে, এবারও করবে। বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলায় ফিরে আসবে। সেই সাথে ঘরে বাইরে বাঙালিরা পান্তাভাত-ইলিশ খেয়ে আমাদের ঐতিহ্যকে স্মরণ করবে।

তবে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে রাজধানীসহ সারাদেশের নানা জায়গায় মেলা হবে। যে মেলার নাম বৈশাখী মেলা। এস মেলায় পাওয়া যাবে শিশুদের আনন্দ দেবার অসংখ্য উপকরণ। যেমন মাটির খেলনা পুতুল, বাউল গানের একতারা-দুতারা ও মিস্টান্ন নানা খাবার। মাটির খেলনা পুতুলের মধ্যে রয়েছে পশু পাখি ফল নৌকা হাঁড়ি পাতিল ইত্যাদি।

মিস্টান্ন খাবারের মধ্যে জিলাপি, খাজা, গজা, কটকটি, মুড়ি উল্লেখযোগ্য। বাঁশের তৈরী বাঁশি ও বেলুন মেলায় পাওয়া যাবে। নানারঙের প্লাস্টিক চুড়িও পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে নানা আকৃতির নানা নামের ঘুড়ি। এগুলি আমাদের শিশু কিশোরদের মন রাঙিয়ে দেবে। আমাদের ঐতিহ্যকে তারা লালন করতে শিখবে।

বাংলা সনকে উপলক্ষ করে এই বর্ষবরণ উৎসব সারাদেশে বিভিন্নভাবে পালিত হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র বাঙালি জনগোষ্টিও বাংলা নববর্ষ পালন করবে। এবারের উৎসবে অবশ্যই আমাদের চাওয়া পাওয়া থাকবে নতুন বছরের দিনগুলিতে এদেশের প্রতিটি মানুষ যেনো ডাল-ভাত খেয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এদেশ থেকে চিরতরে যেন খুন-গুম দূর হয়। সাম্প্রতিক ও অদূর অতীতে যে সব খারাপ ঘটনা ঘটেছে তা যেনো আবার না ঘটে। প্রতিটি নাগরিক যেনো  অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারে। দেশে যেনো প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ। দূর হয় দুর্ণীতি।

আবার উৎসবকে কেন্দ্র করে যেনো অপ্রীতিকর কোন কিছু না ঘটে, সে দিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে আমাদেরকের শালিনতার ভেতরে থেকে উৎসব পালন করতে হবে। তবেই বর্ষবরণ উৎসব স্বার্থক হবে।

লেখকঃ কবি ও কথাসাহিত্যিক

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts