অমোঘ সেই নিয়ম মেনে বিদায় নিচ্ছে আরও একটি বছর। ১৪২২ বঙ্গাব্দের শেষ দিন ৩০ চৈত্র আজ। আজ বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের দিন চৈত্রসংক্রান্তি। চৈত্রের শেষ দিন। ঋতুরাজ বসন্তেরও। বাংলা সন ১৪২২ তার শেষ গান গেয়ে আজ বিদায় নেবে। বসন্তকে বিদায় জানিয়ে আসবে নতুন বছর। বৈশাখ আসবে নতুন দিনের বারতা নিয়ে।
আবহমানকাল থেকে নানা লোকাচার উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উৎসবটি পালন করে আসছে বাংলাদেশের মানুষ। মূল আয়োজন গ্রামে হলেও নগর সংস্কৃতিতে এর কদর এখন যথেষ্ট। শেকড় সন্ধানী মানুষ বর্ণাঢ্য আয়োজনে আজ উদযাপন করবে চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণ। একইসঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে গোটা দেশ।
চৈত্র সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শেকড়ের টানে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বাঙালিরা। পহেলা বৈশাখকে বরণ করার জন্য চলছে দেশজুড়ে উৎসবের প্রস্তুতি। এখন শেষ পর্যায়ে। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলা সনের শেষ দিনটিতে আজ চৈত্র সংক্রান্তির মেলা ও নানা পর্ব মনে করিয়ে দিচ্ছে নতুন বছর দোরগোড়ায়। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে লোকমেলার আয়োজন গ্রামগঞ্জেই হয় বেশি। মেলা, গান-বাজনা, যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে উঠে আসে লোকজ সংস্কৃতির নানা সম্ভার। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মেতে ওঠে পূজা-অর্চনায়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
জানা যায়, চৈত্র মাসে স্বামী, সংসার, কৃষি, ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। জিয়ল মাছ (পানিতে জিইয়ে রাখা যায় এমন মাছ) যেমন কৈ শিং মাগুরের ঝোল করে খেতেন তারা। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতো খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক খেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতোÑ সারা বছরের কৃষি কর্ম ঠিক ছিল। ফলে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা।
গ্রামের নারীরা এ সময় মাটির ঘরদোর লেপা-পোছা করেন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে রাখাল। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্না। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলে আপ্যায়ন। গ্রামের গৃহস্থরা এ দিন নতুন জামা কাপড় পরে একে অন্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন।
চৈত্রসংক্রান্তির আরেকটি বড় উৎসব ‘চড়ক’। চৈত্র মাসজুড়ে সন্নাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্নভোজন প্রভৃতি নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝোলেন। আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটেন। ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত দেখতে সকল ধর্মবর্ণের মানুষ এসে জড়ো হন। আনন্দে মাতেন। এ আয়োজনের সঙ্গে আরও চলে গাজনের মেলা। এসব মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত। যেমনÑ শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি।
বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী, এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পতœীরূপে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিয়ে দেওয়াই এ উৎসবের উদ্দেশ্য। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাসও কাজ করে।
ধারণা করা হয়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচন্ড উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল।
গাজনের মেলা ছাড়াও হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মেলায় মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি, দই পাওয়া যায়। এক সময় মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বায়স্কোপ, সার্কাস ও পুতুল নাচ।
এসব আকর্ষণে দূর গ্রামের দূরন্ত ছেলেমেয়েরাও মেলায় যাওয়ার বায়না ধরত। মেলা উপলক্ষে গ্রামের গৃহস্থরা মেয়ে, মেয়ের জামাই ও নাতিনাতনিদের আমন্ত্রণ করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। বর্তমানে এসব আচার অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। বদলেছে। ধরন পাল্টিয়েছে। তবে চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন থেমে থাকেনি। বরং নতুন নতুন উপাদান এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।