গত শনিবার আমাকে একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি বললেন, “স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত মনে আসতে পারেন। আপনাকে স্টেজে বসতে হবে না, বক্তৃতা শুনতে হবে না, বক্তৃতা দিতেও হবে না!”
যে অনুষ্ঠানে স্টেজে বসতে হয় না, বক্তৃতা শুনতে হয় না কিংবা বক্তৃতা দিতে হয় না সেটা দেখার আমার আগ্রহ হল। তাই শনিবার দিন সকাল বেলা আমি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি এটি একটি বৈশাখী হাট, তবে অন্য দশটা বৈশাখী হাট থেকে ভিন্ন। গেটে বড় বড় করে লেখা, ‘বৈশাখী উদ্যোক্তা হাট’। আমি অনেক রকম হাট দেখেছি, আমাদের দেশে ছবির হাট আছে, গাড়ির হাটও আছে। আমস্টারডামে উল্কি (tattoo) হাট দেখেছিলাম, কিন্তু কখনও উদ্যোক্তা হাট দেখিনি। এখানে দেখে আমি চমৎকৃত হলাম।
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ভিতরে গেলাম। মনে পড়ল বছর খানেক আগে এই উৎসাহী তরুণেরা মিলেই উদ্যোক্তাদের একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। সেই আন্দোলনের মূল শ্লোগানটি ছিল খুব মজার: ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’। আমাদের দেশের মানুষের জন্যে এ রকম একটা শ্লোগান যথেষ্ট সাহসী শ্লোগান। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে এই দেশের মানুষ চাকরির জন্যে খুব ব্যস্ত। বিশেষ করে সেই চাকরিটা যদি সরকারি চাকরি হয় তাহলে তো কথাই নেই। এ রকম একটা অবস্থায় নিজের জন্যে চাকরিকে অস্বীকার করে অন্যকে চাকরি দেওয়ার কথা বলতে নিশ্চিতভাবেই বুকের পাটা দরকার।
আয়োজকদের কাছে জানতে পারলাম, তারা যেখানে এই হাটের আয়োজন করেছেন সেই জায়গাটা খুব বড় নয়, তাই বাধ্য হয়ে শত শত উদ্যোক্তার ভেতর থেকে মাত্র চল্লিশটির মতো উদ্যোক্তাকে লটারি করে বেছে নিতে হয়েছে। এখানকার এই গোটা চল্লিশেক উদ্যোক্তার বাইরেও দেশে অসংখ্য উদ্যোক্তা কাজ করে যাচ্ছেন।
উদ্যোক্তা শব্দটির ইংরেজি ‘আন্ট্রেপ্রেনিউর’ (entrepreneur)। শব্দটার বানান কিংবা উচ্চারণ দুটিই যথেষ্ট কঠিন হলেও এটা আজকাল পৃথিবীর মাঝে খুব প্রচলিত একটা শব্দ। পৃথিবীতে নানা ধরনের ব্যবসায়ী আছে। ভালো ব্যবসায়ীর পাশে পাশে মন্দ ব্যবসায়ী আছে। সৎ ব্যবসায়ীর পাশে পাশে অসৎ ব্যবসায়ী আছে। নিরীহ ব্যবসায়ীর পাশে পাশে দুর্ধষ ব্যবসায়ী আছে। শুধু তাই না, আমাদের দেশে অনেক ব্যবসায়ী আজকাল রাজনীতি করেছেন, নির্বাচন করে সাংসদ হয়েছেন, সাংসদ হয়ে অনেকেই অপকর্ম করে দুর্নামের ভাগী হয়েছেন।
তাই ব্যবসায়ী শব্দটা শুনলেই আমাদের অনেকেরই মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়, আমরা খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাই।
যারা উদ্যোক্তা তারাও কিন্তু ঘুরেফিরে ব্যবসাই করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে এই শব্দটিতে কোনো নেতিবাচক গন্ধ নেই। বরং উদ্যোক্তা শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে উৎসাহে টগবগ করা কমবয়সী একজন তরুণ কিংবা তরুণীর চেহারা ভেসে উঠে। মনে হতে থাকে সেই তরুণ তরুণী সৃজনশীল কোনো একটা নূতন আইডিয়া নিয়ে সম্পূর্ণ নূতন একটা কিছু করতে চাইছেন। নূতন কিছু করতে গিয়ে সফল হতে না পারা অনেক উদ্যোক্তার ইতিহাস থাকার পরও আমাদের উদ্যোক্তা শব্দটা শুনলে বিল গেটস, স্টিভ জবস কিংবা জুকারবার্গের কথা মনে পড়ে। তাই আমরা সব সময়ই চারপাশে অসংখ্য উদ্যোক্তা দেখতে চাই।
উদ্যোক্তা হাটে এসে আমার সেই আশা পূরণ হল। আমি একসাথে অনেক কয়জন কমবয়সী উৎসাহী উদ্যোক্তার দেখা পেলাম। কেউ কেউ মাত্র শুরু করেছে। কেউ কেউ গত কয়েক বছরে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি অন্যদের চাকরি দিতে শুরু করেছে!
আয়োজকদের নিয়ে বেলুন উড়িয়ে উদ্যোক্তা হাট উদ্বোধন করা হল। ঢাকা শহরের আকাশে বেলুন উড়ানো খুব কঠিন কাজ। উঁচু উঁচু বিল্ডিং এবং ইলেকট্রিক তারের ফাঁক গলে বেলুন খুব বেশি দূর উঠতে পারে না। তাই আমাদের বেলুনগুলোও কাছাকাছি একটা ইলেকট্র্রকি তারে আটকে গেল। সেটি নিয়ে কেউ বিচলিতও হল না। উদ্বোধনের পর আমরা উদ্যোক্তা হাটে উদ্যোক্তাদের দেখতে গেলাম।
উদ্যোক্তা হাটের উদ্যোক্তাদের মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ তাদের নিজেদের তৈরি কোনো এক ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। অন্য ভাগ নিজেদের উদ্ভাবিত কোনো এক ধরনের সেবা বিক্রি করেন।
পণ্যগুলোর বৈচিত্রের কোনো শেষ নেই। আমাদের পরিচিত পোশাক, বুটিক, জুয়েলারি কিংবা হ্যান্ডিক্র্যাফটস তো আছেই, এর সাথে আছে চামড়াজাত নানা রকম ব্যাগ, ফোল্ডার কিংবা স্যুভেনির।
আমরা যখন বিদেশে যাই তখন সব সময়ই ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে ছাপ দেওয়া কোনো কিছু কিনে আনি। ঠিক সে রকম বাইরের দেশ থেকে কেউ এলে তারাও যেন বাংলাদেশের ছাপ দেওয়া কোনো একটা স্যুভেনির কিনে নিয়ে যেতে পারে সে জন্যে দেশের নানা ধরনের স্মারক দিয়ে তৈরি নানা কিছুর পশরা নিয়ে বেশ কয়জন উদ্যোক্তা হাজির আছেন।
আজকাল ভেজালের কারণে অনেকেই বিষমুক্ত খাবার খুঁজে বেড়ান। তাদের জন্যে পুরোপুরি বিষমুক্ত অর্গানিক খাবারও আছে এবং সেই কৃষিপণ্যের তালিকা দীর্ঘ। সফটওয়্যারকে পণ্য বলা যাবে কি না আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্যে তৈরি সুনির্দিষ্ট সফটওয়্যার যদি বিক্রয় করার জন্যে হাজির করা হয় তাহলে আমরা সেটাকে পণ্য না বলি কেমন করে? এ ধরনের সফটওয়্যার নিয়েও বেশ কিছু উদ্যোক্তা হাজির হয়েছেন।
একটি খুব মজার পণ্য ছিল, রুটি তৈরি করার একটি মেশিন। যারা নিজের হাতে রুটি বেলার চেষ্টা করেছে, শুধু তারাই জানে কাজটি কত কঠিন। কিন্তু এই মেশিনটি দিয়ে প্রতিবারই নিখুঁতভাবে পুরোপুরি গোল রুটি বানানো যায়। মেশিনটি দেখে আমার প্রায় তিন যুগ আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এই লেখাটির সাথে সেই স্মৃতি পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক, তারপরও সেটা না বলে পারছি না।
আমি এবং আমার স্ত্রী তখন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করার জন্যে সিয়াটল শহরে থাকি। শহরের বাঙালিদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়– এক ভাগে আমাদের মতো কমবয়সী ছাত্রছাত্রী, অন্যভাগে একটুখানি বয়স্ক চাকরিজীবী। সেই বাঙালিদের ভেতর বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলা দুই অঞ্চলের বাঙালিই আছে। আমাদের ঈদে পশ্চিম বাঙলার বাঙালিরা আমাদের সাথে আনন্দ করতে চলে আসে। তাদের পূজা-পার্বনেও আমরা তাদের সাথে উৎসব করতে চলে যাই।
সে রকম কোনো একটি পূজা অনুষ্ঠানে সিয়াটল শহরের বাঙালিরা মিলে অনেক বড় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানের জন্যে সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে ছাত্রছাত্রীদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কয়েক শত লুচি তৈরি করার। সন্ধ্যেবেলা আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘‘চল, আজকে লুচি তৈরি করার বিশাল দক্ষযজ্ঞ দেখে আসি। আমরা তো লুচি তৈরি করতে পারি না, বিষয়টা শিখে আসি।”
নির্দিষ্ট বাসায় গিয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার সব ছাত্রছাত্রী লুচি তৈরি করার জন্যে চলে এসেছে, কিন্তু তাদের কেউই জীবনে কখনও লুচি তৈরি করেনি। কীভাবে তৈরি করতে হয় সেটাও তারা জানে না। সবচেয়ে আতংকের ব্যাপার, সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, আমার নেতৃত্বে তারা এই লুচি তৈরির প্রজেক্টে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
কোনো উপায় না দেখে আমি প্রবাসী বাঙালির অমূল্য গ্রন্থ সিদ্দিকা কবীর রান্নার বই নিয়ে লুচি তৈরির কাজে লেগে গেলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আবিষ্কার করলাম, যতভাবেই চেষ্টা করা হোক লুচি কোনোভাবেই গোল হতে চায় না। বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বড় বড় বিষয়ের পিএইচডি করতে থাকা ছাত্রছাত্রীরা নানা বিষয়ে গবেষণা করতে শিখেছে, কিন্তু শত গবেষণা করেও তখন কেউ গোলাকৃতির লুচি তৈরি করতে পারছিল না। আমাদের লুচি পৃথিবীর নানা দেশের ম্যাপের আকৃতি নিতে শুরু করল এবং আমরা একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে তাতেই সন্তুষ্ট থাকলাম।
পরের দিন সেই পূজা উৎসবে আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের তৈরি লুচি নিয়ে যা হাসি-তামাশা হল সেটি আর বলার মতো না!
উদ্যোক্তা হাটে আমি গোলাকার রুটি তৈরি করার এই মেশিনটির দিকে তাকিয়ে তিন যুগ আগে ঘটে যাওয়া সেই ‘হৃদয়বিদারক’ ঘটনার কথা স্মরণ করে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। তখন যদি আমার হাতে এই যন্ত্রটি থাকত তাহলে কেউ আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারত না।
উদ্যোক্তা হাটে বিচিত্র পণ্যের যে রকম সমাহার ছিল ঠিক সে রকম ছিল বিচিত্র সেবার সমাহার। আমার মনে হয় এক হিসাবে সেবাগুলোর মাঝেই বৈচিত্র্য কিংবা সৃজনশীলতা ছিল বেশি। যে রকম আমাদের সবারই অসুখ-বিসুখ হয়, আমরা সবাই জানি, এই দেশে অসুখ-বিসুখ হলে সত্যিকারের চিকিৎসা পেতে হলে নিজের পরিচিত ডাক্তার থাকতে হয়। যাদের ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ডাক্তার নাই তাদের জীবনে কী ধরনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হতে পারে আমাদের কাছে তার বিশাল একটা তালিকা আছে।
সম্ভবত সেই ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া কোনো একজন উদ্যোক্তা সঠিক এবং সত্যিকারের ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবার জন্যে একটি ব্যবস্থা করে রেখেছে, দেশের যে কোনো জায়গায় ফোন কিংবা নেটের মাধ্যমে ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা যাবে।
সেবাগুলোর মাঝে স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটা করার অনেকগুলো উদ্যোগ আছে, কিন্তু তার মাঝেও বৈচিত্র্য আছে। একটা সময় ছিল যখন বাইরে কোথাও কোনো ছোটখাট যন্ত্রপাতি (সাধারণ ভাষায় অনেক সময় আমরা যেগুলোকে ‘গেজেট’ বলি) বের হলেও দেশে বসে আমরা সেগুলো পেতাম না। একজন উদ্যোক্তা শুধুমাত্র সেগুলো নিয়ে এসে বিক্রি করার ব্যবস্থা রেখেছেন। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একটা ছোট ‘গেজেট’ যেটা চোখে লাগিয়ে ভার্চুয়াল জগৎ দেখার একটা হুজুগে সারা পৃথিবীতে মাতামাতি হচ্ছে, আমি দেখলাম সেটিও এখানে আছে। এটাকে বড় মানুষের খেলনা বলা যায়। এ রকম বড় মানুষের খেলনার কোনো অভাব নেই এবং এই উদ্যোক্তা দেশে বসে সেগুলো পাবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
ভেজাল কসমেটিকসে দেশ ভরে গেছে। তাই একজন একেবারে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে খাঁটি কসমেটিকস এনে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাইরের পৃথিবীতে ই-কমার্সে কেনাকাটা করার জন্যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়, আমাদের উদ্যোক্তারা কেনাকাটার কাজটা ক্রেডিট কার্ড থেকে সহজ করে রেখেছেন। নেটে কোনো কিছু অর্ডার দিলে পণ্যটা একেবারে বাসায় পৌঁছে দিয়ে হাতে হাতে দাম নিয়ে যাবে। এত আরামের কেনাকাটা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
সেবা দেওয়ার ভেতর ফটোগ্রাফররাও আছেন। বাংলাদেশে ঘুরে বেড়ানোর কাজে সাহায্য করার জন্যে ভ্রমণের সেবাও আছে। একটু শীত পড়তেই আমাদের ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা শিক্ষা ছুটিতে বের হয়ে যায়। মনে আছে কয়েক বছর আগেও সেই শিক্ষা ছুটির সব কিছু ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ব্যবস্থা করতে হত। আজকাল কারও ঘাড়ে দায়িত্ব দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চিন্ত মনে শিক্ষা ছুটিতে বের হয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশে এখন নানা ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস রয়েছে। উদ্যোক্তা হাটে এসে আমি আরও নূতন এক ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস আবিস্কার করলাম। এই কুরিয়ার সার্ভিস বাইসাইকেলে জিনিসপত্র জায়গামতো পৌঁছে দেয়।
সাইকেল বাহনটা আমার খুব পছন্দের বাহন। অপেক্ষা করে আছি কখন ঢাকা শহরের বড় বড় রাস্তার পাশে আলাদা ছোট ছোট সাইকেল লেন তৈরি করে দেওয়া হবে এবং রাতারাতি ঢাকার যানজট ম্যাজিকের মতোন অদৃশ্য হয়ে যাবে। যতদিন না হচ্ছে বাইসাইকেল চালকদের বাংলাদেশের ভয়ংকর রাস্তায় সাহস করে সাইকেল চালানোর জন্যে অভিনন্দন জানিয়ে যাই। বাইসাইকেলে করে কুরিয়ার সার্ভিস নিঃসন্দেহে অতি চমৎকার একটা সেবা।
উদ্যোক্তা হাটে এসে আমি আরও একটি নূতন সেবা আবিষ্কার করেছি, হয়তো এটি আগেও ছিল, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। এই সেবাটি হচ্ছে অফিসের জন্যে জায়গা ভাড়া দেওয়া। আমার ধারণা, একেবারে নূতন উদ্যোক্তাদের বড় একটা সমস্যা হচ্ছে একটা অফিস এবং একটা ঠিকানা। কমবয়সী একজন তরুণ কিংবা তরুণীর পক্ষে ঢাকা কিংবা ঢাকার মতো বড় শহরে একটা অফিস ভাড়া করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাদের হাতে এত টাকা নেই। টাকা যদিও-বা থাকে কমবয়সী তরুণ তরুণীকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না।
আমার কন্যা টেলিফোনে মানসিক সেবা দেওয়ার জন্যে ‘কান পেতে রই’ নামে একটা সংগঠন দাঁড় করিয়েছিল। খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করার আগে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে আমাকে জানিয়েছিল, সে আমার কিংবা আমার স্ত্রীর কোনো সাহায্য না নিয়ে কিংবা আমাদের পরিচয় ব্যবহার না করে পুরো সংগঠনটি দাঁড় করাবে। সত্যি সত্যি আমাদের কোনো সাহায্য ছাড়াই কমবয়সী তরুণ তরুণী ভলান্টিয়াররা মিলে সংগঠনটি প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল।
কিন্তু যখন একটা বাসা ভাড়া করার প্রয়োজন হল, হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, তাদের মতো কমবয়সী তরুণীদের বাসা ভাড়া দেওয়া দূরে থাকুক, বাড়িওয়ালারা তাদের সাথে বাসা ভাড়া-সংক্রান্ত কথা বলতেই রাজি নয়। আমাদের কন্যা তখন তার সমস্ত অহংকার বিসর্জন দিয়ে আমাদের কাছে এসেছিল এবং আমরা টেলিফোনে কথা বলে বাড়িওয়ালাদের আশ্বস্ত করে একটা বাসা ভাড়া করিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি নিশ্চিত এই দেশের তরুণ তরুণী উদ্যোক্তাদের আমার কন্যার মতোই একটা অফিস ভাড়া করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় এবং বড় মানুষদের পিছনে ছোটাছুটি করতে হয়। উদ্যোক্তা হাটে অফিস ভাড়া করার এই চমৎকার ব্যবস্থাটি দেখে আমি স্বস্তি পেয়েছি যে, খুব নূতন একজন উদ্যোক্তার নিজস্ব একটি ঠিকানা নিয়ে কাজ শুরু করার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেল।
সেবা দেওয়ার মাঝে একটি উদ্যোগ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। সেটি হচ্ছে উদ্যোক্তাদের উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করার উদ্যোক্তা! এই উদ্যোক্তা নূতন উদ্যোক্তাদের সাহায্য করেন, কী কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে সেই বিষয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয়, উদ্যোক্তা হতে হলে কী করতে হয় তার উপর একটি বই পর্যন্ত লেখা হয়েছে। বইটির নাম ‘উদ্যোক্তার অ আ ক খ’। আমি বেশ অনেকগুলো কপি কিনে এনেছি আমার পরিচিত ছাত্রছাত্রী যারা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদেরকে উপহার দেবার জন্যে।
আমাদের দেশ থেকে সবাইকে আমরা শুধু শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পাঠাতে চাই। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে আমাদের অর্থনীতি সচল হচ্ছে। কিন্তু প্রবাসে এই নিঃসঙ্গ শ্রমিকদের জীবন কী আনন্দময় নাকি দুঃসহ সেটি কখনও ভেবে দেখি না। আমরা যদি এই দেশের তরুণ তরুণীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যে আলাদাভাবে সাহায্য করতাম তাহলে হয়তো একজন নিজ দেশেই মায়ের স্নেহে ভাইয়ের সহায়তায় বোনের ভালোবাসায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত।
বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের কথা ভেবে হাহাকারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হত না।
লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।