দেড় বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার দায়ে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং ওই থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এছাড়াও পরিদর্শক নন্দদুলাল রক্ষিত, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব এবং পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এপিবিএনের তিন সদস্য উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহসহ ৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
সোমবার বিকালে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। গত ১২ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছিলেন আদালত।
এর আগে দুপুর ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তায় প্রিজন ভ্যানে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয় মামলার ১৫ আসামিকে। তাদেরকে সামনে রেখেই রায় শোনান বিচারক।
তিনশ’ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণার শুরুতেই মামলাটিতে নিজের পর্যবেক্ষণ জানিয়ে বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত। হত্যায় আসামি লিয়াকত আলী ও নন্দদুলালের সক্রিয় ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে।
এদিন ছেলে হত্যা মামলার রায় শুনতে মা নাসিমা আক্তারকে নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আসেন মামলার বাদী ও মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
গত বছরের ২০২১ সালের ২৭ জুন প্রদীপসহ ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। অভিযোগপত্রে থাকা ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
তার আগে প্রায় চার মাস তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। তাতে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
হত্যার ঘটনার কয়েকদিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। তাতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। পরে তদন্ত শেষে আরও ৬ জনকে নতুন আসামি করা হয়।
বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী ছাড়াও আসামি করা হয় প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।
এছাড়াও আসামি হন টেকনাফ থানায় করা পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
ওই ঘটনার পর পুলিশের দাবি করে, ‘সাবেক ওই সেনাকর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গাড়িতে এক সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন। চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে তিনি বাধা দেন। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সেনাকর্মকর্তা তার সঙ্গে থাকা পিস্তল বের করার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়।’
পুলিশ আরও দাবি করে, সাবেক ওই সেনাকর্মকর্তার গাড়ি তল্লাশি করে ৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, কিছু গাঁজা ও দুটি বিদেশি মদের বোতল পাওয়া গেছে। ঘটনার পর তিনটি মামলা করে পুলিশ।
তবে পুলিশের এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি নিহতের পরিবার। তারা শুরু থেকেই দাবি করেন সিনহাকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ হত্যা করা হয়। পরে তদন্তে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির অনুসন্ধানেও উঠে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
পরে জানা যায়, সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার পর ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। এই সময়টায় আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে ‘নীলিমা’ নামের একটি রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন তিনি।
ঘটনার দিন ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের কাজ শেষে করে ওই রিসোর্টে ফিরছিলেন রাশেদ এবং তার এক সঙ্গী। পথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।