আখতার-উজ-জামান ॥ আজ মা দিবস। যদি প্রশ্ন হয় কোন শব্দে সবচেয়ে বেশি আকুলতা, বেশি আবেগ, নিবিড় টান আছে-বিতর্ক ছাড়াই একটি উত্তরই আসবে প্রথিবীজুড়ে ‘মা’। মায়ের সঙ্গে সন্তানের গভীরতম সম্পর্কের কাছে সব সম্পর্কই যেন গৌণ। যে সম্পর্কের সঙ্গে আর কোনো তুলনা হয় না। একটি আশ্রয়র নাম ‘মা’। একটি শব্দই মনে করিয়ে দেয় অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা আর গভীর ভালোবাসার কথা। মা চিরন্তন। শুধু বিশেষ দিন নয়; মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রতিটি দিনের।প্রতিটি মুহূর্তের।
আজ বিশ্ব মা দিবস। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ‘মা দিবস’। প্রশ্ন জাগতে পারে, মা-তো প্রতিদিনের, প্রতিণের। তাহলে ‘মা’ নিয়ে আবার বিশেষ দিন কেন? কিন্তু তি কী, যদি একটি বিশেষ দিনে মায়ের দিকে আরেকবার প্রাণভরে তাকাই, যারা দূরে থাকি তারা আরেকবার মাকে বিশেষভাবে স্মরণ করি।
মাকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে নির্দিষ্ট দিনণ ঠিক করা অনেকের কাছেই প্রহণযোগ্য না হলেও মাকে সম্মান দেখাতে, স্মরণ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মা দিবসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মায়ের হাতে মা দিবসের কার্ড দিয়ে কিংবা মায়ের প্রিয় রঙের শাড়িটি তুলে দিয়ে। অথবা মাকে চমকে দিয়ে তাঁরপ্রিয় খাবারটি নিজের হাতে রান্না করে। অপরিশোধ্য মাতৃঋণের বদলে মাকে ণিকের আনন্দ দিয়ে খুশি হবে সন্তানেরা। দূরে থাকা মায়ের ছোঁয়া যাঁরা পাবেন না, তাঁরা দ্বারস্থ হবেন মুঠোফোনের। আর মাতৃহারা সন্তান বুকের সবকষ্ট চেপে মনে মনে বলে উঠবে, ‘আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো’।
‘মা যে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরিয়া, করেছেন আমাদের ঋণি, গায়ের চামড়া কাটিয়া দিলেও, সেই ঋণ সুদ হবেনা জানি’। ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম’। ‘এমন একটা মা দেনা’। ‘মাগো মা, ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’। এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস আর নাটক যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে তার নাম ‘মা’। এ বিষয়ে একটি ঘটনা খুব উল্লেখযোগ্য।
এক ব্যক্তি বিশ্ব মুসলিম জাহানের শান্তির দূত মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম -এর নিকট এসে জানতে চাইল কে তার কাছে বেশি সেবা পাবার হকদার। রাসূল (সা:) বললেন তার মা। লোকটি একই প্রশ্ন তিনবার করলো। আর রাসূল (সা:) তিনবারই বললেন তার মায়ের কথা। তবে চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রাসূল (সা:) তার বাবার কথা বললেন।
মা দিবস উদযাপনের ধারণাটি প্রথম মাথায় আসে মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের। তবে ‘আধুনিক’ মা দিবসের ধারণার প্রবর্তক অ্যান জার্ভিস। শান্তিকর্মী অ্যান জার্ভিস যুদ্ধবিধ্বস্ত আমেরিকার নারীদের নিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা নিয়ে প্রচার ও কাজ শুরু করেছিলেন। ১৮৬৮ সালে তিনি নারীদের সংঘবদ্ধ করেন এবং আমেরিকার কিছু জায়গায় প্রচারণা চালান টমেটোর চারা যেন সবাই মা দিবসের পরই রোপণ করেন।
‘মা দিবস’-এর প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন গ্রিসে। সেখানে প্রতি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’, যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিণী তার উদ্দেশ্যে উদযাপন করা হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘মা দিবস’ পালিত হতো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে বেশির ভাগ দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার দিনটি পালিত হয়।
আবার কথিত আছে- আজ থেকে ১৫০ বছর আগের রবিবার সকালটা অ্যানা জারভিসের জন্য একদম অন্যরকম হতো। নিজের প্রতিষ্ঠিত সানডে স্কুলে বাচ্চাদের দিতেন বাইবেল পাঠ। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো তার নিজের। এদের মুখাবয়বে খুঁজে পেতেন নিজ মায়ের মুখ। ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় বিনম্র হতে ইচ্ছে করত মায়ের প্রতি। এ বোধ থেকেই ১৯০৫ সালে মাকে ভালবাসা ও সম্মান জানাতে প্রবর্তন করেন মাদার্স ডে বা মা দিবসের। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্বীকৃতি ও প্রসার ঘটে ১৯১৪ সালে।
তবে মা দিবস উদযাপনের সূত্রপাত ঘটায় মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্টস। প্রতিবছর মে মাসের চতুর্থ রোববারকে মাদারিং সানডে হিসাবে পালন করা হতো ব্রিটেনে। এটা ছিল সতের শতকের কথা। মায়ের সঙ্গে সময় দেয়া ও মায়ের জন্য উপহার কেনা ছিল দিনটির কর্মসূচিতে। এরপর আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে প্রথম মা দিবস পালন করা হয় ১৮৫৮ সালে। জুনের ২ তারিখকে তারা বেছে নিয়েছিল মা দিবস হিসাবে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উহলসন সর্বপ্রথম মা দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেসে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা’ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে এই দিনে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে মা দিবস। অ্যান জার্ভিস দিনটির সরকারি অনুমোদন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা চালাতে থাকেন; কিন্তু সফল হতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে অ্যানা জার্ভিস মায়ের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের কাজে হাত দেন। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন একটি বিশেষ দিন ঠিক করে ‘মা দিবস’টি উদযাপন করার জন্য। সে ল্েযই ১৯০৮ সালের ১০ মে তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফিটন শহরের সেই চার্চে, যেখানে তার মা অ্যান জার্ভিস রোববার পড়াতেন সেখানে প্রথমবারের মতো দিনটি উদযাপন করলেন। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিস্তার হতে থাকে চারপাশে এবং এক সময় এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। তাই আজ সীমানা বিহীন ভালোবাসার একটি দিন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর এবং প্রিয় শব্দটি বলার একটি দিন। ১৯১১ সাল থেকে এই দিনটি পালন হয়ে আসছে ‘মা দিবস’ হিসেবে। সর্ব প্রথম ১৯১১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আমেরিকা জুড়ে পালিত হয় প্রথম ‘মা দিবস’। ‘মা-দিবস’ এর আইডিয়াটা করেছিলেন, ১৮৭০ সালে জুলিয়া ওয়ার্ড হাওই নামের আমেরিকান সমাজকর্মী এক মহিয়সী মহিলা। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন, যুদ্ধে আহত, নিহিত, হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মায়েদের বুকের ক্রন্দন, তাদের অন্তর-আত্মার বেদনা।
বিশ্বকে তিনি শুনিয়েছিলেন এক সাম্যের বাণী। সন্তানের জন্যে জগতের সকল মায়ের ভালবাসায় কোন ভিন্নতা নাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্যে কোন মায়ের বুকের ধন কেড়ে নেয়া অন্যায়। তিনি এর প্রতিবাদে বিশ্বের সকল মাকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান করেন। যদিও তিনি তার কাজে পুরোপুরি সফলকাম হতে পারেন নি, তার এই মহান কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন এ্যানা জার্ভিস এর কন্যা, দ্বিতীয় এ্যানা জার্ভিস।
জুলিয়া ওয়ার্ডের পথ ধরে সুদীর্ঘ ৩৭ বৎসর সংগ্রামের পর ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো ‘মা দিবস’ উৎসব পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে উদযাপিত হয়। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে এপ্রিল থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ মহান দিনটি পালিত হয়। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিস্তার হতে থাকে চারপাশে এবং এক সময় এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মা দিবস পালিত হয়। কারণ দিবসটি উদযাপনের সূত্রপাত বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। তবে বেশীর ভাগ দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার দিনটি পালিত হয়।
আম্মা তোমাকে খুব মনে পড়ে। বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আপনি যেমনটি করে আটটি সন্তানকে লালন পালন করেছেন সেটি আমার দৃষ্টিতে খুবই নজিরবিহীন। আমি তখন ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করি। প্রতিদিনের ন্যায় আমার আম্মা ফজর নামায শেষে পুরো বাড়িটির আঙ্গিনা নিজের হাতে ঝাড়– দিতেন। এক তলা ভবন আর টিনসেড বাড়িটির সামনে কিছু ফুলের গাছে (বেইলী, গন্ধরাজ, হাসনেহানা) নিজ হাতে পানি দিতেন। তারপর আমাদের কোন না কোন ভাইকে বলতেন, আমার জন্য চা নিয়ে আয়। তখন সুশান ভাই নাস্তার সাথে আম্মার জন্য চা নিয়ে আসতো। আম্মা নাস্তা-চা-পান সেরে আবার পুকুর ঘাঁটে গিয়ে থালাবাসন ধুয়ে-মুছে সাফ করতেন। কোন কোন সময় আমি আম্মাকে সহযোগিতা করতাম কিছু কাজে। আমার আম্মা সব সময় নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন।
১৯৯৪ সালের ২৫ মে, রোজ বুধবার। প্রতিদিনের ন্যায় ঐ দিনও সকাল থেকে আম্মা ব্যস্ত ছিল নিয়ে আমাদের নিয়ে। মিঞা ভাই (রিপন) তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। উচ্চ শিার জন্য সেখানে দাদা ভাই (লিটন)ও ঢাকার বাসায় থাকতেন। কিন্তু হঠাৎ দাদা ভাই অসুস্থ হলে বাড়িতে চলে আসেন। আম্মা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানটির জন্য সারাদিন টেনশন করতেন, আমার লিটনের কি হয়েছে। তোর কি খেতে মন চায়। কি রান্না করবো তোর জন্য। তুই গরুর গোসস্ত খাসনা। তোর জন্য কলমি শাক ভাজি আর পেঁপে ডাল রান্না করবো। এই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আমার আম্মা। আমি আর আহসান (সর্বকনিষ্ঠ ছেলে) আম্মার কাছাকাছি থাকতাম।
মিলন (মেঝ ভাই) থাকতো আমাদের মার্কেটের নিজ দোকানের কাজে ব্যস্ত। সুশান (সেজ ভাই) ও নোমান বাজারের আশপাশেই ছিল। আরেক ভাই আমান ঢিল ছুঁড়ে মারলো আম গাছে, যদি পাকা আমটি পড়ে যায়। কিন্তু সেই ঢিল এসে পড়লো পাশের বাড়ির জেঠাতো ভাইয়ের ছেলে পারভেজের মাথায়। তাৎণিক মাথা ফেটে রক্ত দেখে আম্মা এতোটা কষ্ট পেলেন, যে বারবার আমানকে বোকা দিচ্ছেন তুই করলি কি? কেন গাছে ঢিল মারলি, এখন কি হবে। যাক সেটি কোন রকম ম্যানেজ করলেন আম্মা। তখন দুপুর পৌনে ২টা আমরা সবাই খাওয়া-দাওয়া করলেও আম্মা ঘরের কাজ সেরে নামায আদায় করার জন্য কলপাড়ে (টিউবওয়েল) গেলেন। হঠাৎ আম্মা বলছেন লিটন আমার খুব খারাপ লাগছে, তোরা কে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে আসলাম আমি, দাদা ভাই আর পাসের বাড়ির জেঠি।
একি আম্মা এইরকম করছেন কেন? আমরা সবাই দৌড়াদড়ি শুরু করলাম ডাক্তার আনার জন্য। ডাক্তার আনা হলো, তখন ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা ৬:১৫ মিনিট। আমার আম্মা আর নেই। চলে গেলেন পৃথিবী আর আট সন্তানকে রেখে না ফেরার দেশে। হে আল্লাহ আমার আম্মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক.. আমীন। মে মাসের ২৫ তারিখে আমার মমতাময়ী’র ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। মরহুমার বাসভবন ‘কলাবাগান বাজার কমপ্লেক্সে বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া মাহফিল আয়োজন করবে। আন্তর্জাতিক মা দিবসে সশ্রদ্ধা ভরে সালাম জানাই আমার মাকে।
আজ আমার মা পৃথিবীতে নেই। সকল সন্তানরা যেন মা’ শব্দটিকে মূল্যায়ন করে। বৃদ্ধা কিংবা অসুস্থ থাকা মাকে কোন সন্তান যেন কষ্ট না দেয়, সেদিকে সবাই সজাগ থাকতে হবে। যেহেতু মা’র বিকল্প কিছুই নেই। ‘মা যে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরিয়া, করেছেন আমাদের ঋণি, গায়ের চামড়া কাটিয়া দিলেও, সেই ঋণ সুদ হবেনা জানি’। ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম’। ‘এমন একটা মা দেনা’। ‘মাগো মা, ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’। এমন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস আর নাটক যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে তার নাম ‘মা’।
ইতিহাস যাই হোক, দিনটির তাৎপর্য এখানে যে, দিনটি মা’কে বিশেষ ভাবে মনে করিয়ে দিয়ে, মা’কে ভালবাসার কথা স্মরণ, ভক্তি করা এবং মা’য়ের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে বরং আমাদেরই যেন লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। শুধু বছরে এক দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিন যেন আমরা মা’কে ভালবাসি, মা’কে শ্রদ্ধা করি-আমরা যেন মা’য়ের ত্যাগ কখনো ভুলে না যাই, মা’য়ের প্রতি কর্তব্য ভুলে না যাই।