গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
দেশে তামাকখাত থেকে রাজস্ব আহরণে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে তামাককর কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক করনীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। কার্যকরভাবে করারোপের অভাবে তামাকপণ্য দিন দিন অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকিতে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।
মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) গবেষণা ও তামাকবিরোধী অ্যাডভোকেসি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র যৌথ উদ্যোগে ‘প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সহজ ও শক্তিশালী তামাককর নীতি বাস্তবায়নে বাধা এবং করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ। এই আয়োজনে সহযোগিতা প্রদান করেছে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে)।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এফসিটিসি আর্টিকেল ৬ ধারায় তামাকের চাহিদা হ্রাসকল্পে সরকারসমূহকে একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। সিগারেটে বহুস্তর বিশিষ্ট অ্যাড-ভ্যালুরেম করকাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট বিদ্যমান। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলকভাবে কমদামি সিগারেট বেছে নিতে পারছে। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো উচ্চস্তরের সিগারেট নিম্ন স্তরে ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
অন্যদিকে, সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল মূল্যস্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে বর্ধিত মূল্যের একটি বড় অংশ তামাক কোম্পানির পকেটে চলে যাচ্ছে। তামাক কোম্পানি লাভবান হচ্ছে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এছাড়া করের ভিত্তি এবং করহার খুবই কম হওয়ায় বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল) অধিক সহজলভ্য থেকে যাচ্ছে। তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১টিতে আনা হলে বিদ্যমান জটিল কর ব্যবস্থা সহজ হবে, সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং জনস্বাস্থ্য উপকৃত হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে সহজ তামাক করনীতির অংশ হিসেবে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সকল সিগারেট ব্রান্ডে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলনের সুপারিশ করা হয়। একইসাথে নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, মধ্যম স্তরে খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮.৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, উচ্চ স্তরে খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যেও সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ শুল্ক প্রচলন করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও মধ্যমেয়াদে (২০২২-২৩ থেকে ২০২৭-২৮) সিগারেটের ব্রান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “সহজ কর কাঠামো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো ঘোষণা দেন তখন সেটা পালন করা সরকারের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে যারা গাফলতি করেন তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”
অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপি বলেন, “সংসদ সদস্যরা আগে এক সময় তামাকের কর বাড়ানোর বিপক্ষে ডিও লেটার দিতেন কিন্তু এখন তারা কর বৃদ্ধির পক্ষে ডিও লেটার দিচ্ছেন। আশাকরি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর এবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।” জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, “তামাককর সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণে স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একসুরে কথা বলতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে মিটিং আয়োজন করে তামাককর সংক্রান্ত এই প্রস্তাব তুলে ধরে তাহলে সেটা বেশি কার্যকর হবে।”
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরো অংশ নেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডে’র এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর, সিপিডির রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে)- বাংলাদেশ এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী এবং ঢাকা আহছানিয়া মিশনের হেলথ ও ওয়াশ সেক্টর পরিচালক ইকবাল মাসুদ।
আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার। এছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) তামাক ব্যবহার করে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।