‘ছোট বেলা থেকে ছেলেটার শত্রু ছিল। এজন্য ওকে পাখির মত ঘরে আটকে রেখে রেখে বড় করেছি। কোথাও যেতে দিতাম না। তিন মাস যাবৎ ওর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। জানতে পারি, বর্ষা নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু মেয়েটি ওর সাথে প্রেম করতো না। ওর প্রয়োজন ছিল টাকার। প্রেমের প্রয়োজন ছিল না। সে (বর্ষা) নিজে আমাকে এটা বলেছে। কিন্তু ছেলেটা বুঝলো না যে মেয়েটা ওর সাথে প্রতারণা করছে। ওর সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর ছেলেটা রাত-দিন শুধু হাতিরঝিলে আড্ডা দিতো। বারবার ওকে সাবধান করেছি। কিন্তু শোনেনি। শেষ পর্যন্ত মারাই গেলো ছেলেটা। ওকে বাঁচাতে পারলাম না।
বলছিলেন রাজধানীর হাতিরঝিলে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করা বজলু মিরাজ চৌধুরী ওরফে রাজের মা নাদিরা বেগম।
গত ১৫ এপ্রিল রাজ হাতিরঝিলে মহানগর প্রজেক্ট এলাকার ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মা নাদিরা বেগম পরদিন রাজের প্রেমিকা নুর মির্জা আক্তার বর্ষাকে আসামি করে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পরই রাজের প্রেমিকা বর্ষাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্ষা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
এদিকে রাজের মায়ের সন্দেহ, তার ছেলেকে হত্যা করে ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি এর সঠিক বিচার দাবি করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের দাবিও জানান তিনি। আগামি ২৯ মে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
রাজের মা নাদিরা বেগম বলেন, ‘ছেলে আমার ছোট থেকেই শান্ত-শিষ্ট। কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করতো না। বাইরেও তেমন থাকতো না। কিন্তু জানুয়ারি মাস থেকে ছেলের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। আকাশ, নীল, আদিত্য ও শামীমের সাথে ওর পরিচয় হয়। পরে বর্ষার সাথে। আকাশকে একদিন আমার মেয়ে ফোন দিয়ে বলে, ও এতিম। ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয় একটু খেয়াল রেখো। একথা বলার পর আকাশ ফোন কেটে দিলো। আরেকদিন ছেলে বাসায় না আসায় আমি ওকে ফোন দেই। ফোনটা বর্ষা ধরে। তাকে বলি, মা দেখো আমার ছেলেটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। একথা বলার পর ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখে। এভাবেই চলছিল।’
তিনি বলেন, ‘এপ্রিলে বর্ষা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করে, পথরোধ করে। আমাকে বিরক্ত করছে। যেভাবে পারেন ওকে আটকান। আমার টাকার দরকার, প্রেমের দরকার না। তখন আমি ওকে বলি, তুমি বন্ধু বা ভাই হিসেবে বুঝিয়ে ওকে বলো। ও যেন এরকম না করে। তখন বর্ষা আমাকে রূঢ় কথা বলে। ১৪ তারিখ রাত ৯ টায় রাজকে ফোন দেই। তখন বর্ষা ফোন ধরে। তাকে আমি বলি, আমার ছেলেটাও বাচ্চা, তুমিও বাচ্চা। রাজকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দাও। বাসায় এলে আমি কথা বলবো। পরে রাজের এক বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে বলে, আমরা চারজন হাতিরঝিলে বসে আছি। রাজ ব্রিজ থেকে লাফ দিতে পায়তারা করছে, লাফালাফি করছে। ওকে এসে নিয়ে যান। আমি বলি, এখন তো অনেক রাত, আমি একা যেতে পারবো না। তখন কিন্তু আমি রাজের কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। রাত ১২ টায় বর্ষা আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, রাজের কি অবস্থা। এরপর রাত সাড়ে ১২ টায় পুলিশ ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ও কি বেঁচে আছে? পুলিশ জানায়, সে বেঁচে আছে। পরে একা একাই বাসা থেকে যাই। গিয়ে দেখি সাদা এপ্রোনে আমার ছেলের লাশ মোড়ানো।
নাদিরা বেগম বলেন, ‘রাজ যে পানিতে লাফ দিয়েছে সেখানে গিয়ে এমন কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না। ওর শরীরে কোথাও পানি নেই। আমার সন্দেহ, ওকে মেরে ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মুখে রক্তও দেখলাম। আগেই সন্দেহ করেছিলাম এমনটা হবে। সেটাই হলো।’
তিনি বলেন, ‘রাজের বাবা ২০১১ সালে সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর ওদের দুই ভাই-বোনকে নিয়েই থাকতাম। জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিলো ওর চাচা, ফুফুদের সাথে। আমার সন্দেহ হয়, ওরা জানুয়ারি মাস থেকে গ্যাং লাগিয়ে দিয়েছে কি না আমার ছেলের পিছে। রাজের বন্ধুদের এ বিষয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে সত্য উদঘাটন করতে পারবে। আমার ছেলে আত্মহত্যা করার মত না। যাদের কারণে আমি ছেলেকে হারালাম তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, এর সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, আপনার ছাত্রলীগের এ কর্মীর সঠিক বিচারটা করে দেন।
মামলা সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার সাব-ইন্সপেক্টর কারিবেল হাসান বলেন, ‘মামলা দায়েরের পরই বর্ষাকে আমরা গ্রেপ্তার করি। প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি, রাজ ও বর্ষার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমঘটিত কারণেই আত্মহত্যার ঘটনাটা ঘটেছে। মেয়েটার চাওয়া পাওয়াটা বেশি ছিল। একারণে ঘটনাটা ঘটেছে। মামলার তদন্ত চলছে। এ অবস্থায় বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তদন্ত শেষে একটা রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো।
নাদিরা বেগমের করা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, রাজের সাথে গত ৩১ ডিসেম্বর বর্ষার পরিচয় হয়। পরে বর্ষা রাজকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারপর থেকে রাজ বর্ষাসহ তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে হাতিরঝিলে আড্ডা দিতো। রাজের কাছ থেকে বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য মানসিক চাপ দিতো বর্ষা। এদিকে বাদীর ছেলে জানতে পারে বর্ষার চরিত্র খারাপ এবং তাকে না জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। বিষয়টি রাজ জানতে পেরে বর্ষাকে ভালো হতে বলে। বর্ষা উল্টো রাজকে বিভিন্ন ধরনের ব্ল্যাকমেইলিংসহ মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এবং বর্ষার অত্যাধিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে রাজ সব সময় মানসিক চিন্তায় ভুগতো। বিষয়টি লক্ষ্য করে বাদী তার ছেলের কাছে কারণটা জানতে চান। জবাবে রাজ জানায়, সে বর্ষাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বর্ষা তার কাছে টাকা পয়সা চায়।
আরও জানা যায়, গত ১৪ এপ্রিল রাত ১০ টার দিকে রাজ বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে যায়। ১৫ এপ্রিল রাত ৮ টার দিকে বর্ষা বাদীকে ফোন দিয়ে জানায়, রাজ তার বাসায় আছে। তাকে নিয়ে যেতে বলেন বর্ষা। পরে বাদী তার ছেলেকে ফোন দিলে সে ধরে না। পরে রাত ১২ টা ২০ মিনিটের দিকে রাজের মোবাইল থেকে কল দেয়। নিজেকে পাঠাও চালক পরিচয় দেন ইকবাল হোসেন। তিনি বাদীকে জানান, ‘আপনার ছেলে একটি মেয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাগ করে হাতিরঝিলের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে।’ তখন তিনি দ্রুত হাতিরঝিলে থানাধীন মহানগর ব্রিজে গিয়ে রাজকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।
ছবি: মা ও বোনের সঙ্গে বজলু মিরাজ চৌধুরী রাজ