ঘটনা অপ্রীতিকর ll আহ্সান ওয়াহিদ এর গল্প

রাস্তায় এতো জ্যাম!

আশুলিয়া থেকে আটটায় রওনা দিয়ে উত্তরার পাঁচ নম্বর সেক্টরে আলমগীর মামার বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটা বেজে যায় আমানের। আলমগীর মামার সাথে আলাপ সেরে তার খিলগাঁও-এর বাসায় ফিরতে আরো দুই ঘণ্টা লাগবে। লাগে লাগুক, তবুও মামার সঙ্গে গতকালের ঘটনাটা শেয়ার করতে হবে। প্রয়োজনে মামার বাসায় রাতটা থেকে যাবে, তবুও আজই মামার কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলতে হবে। যদিও এটা এ গ্রহের কারোর কাছেই প্রকাশ করার মতো নয়; তবুও আমান তার স্ত্রী তামান্নার সঙ্গে একান্তে পরামর্শ করেছে, একমাত্র আলমগীর মামার কাছেই বলা যায় এবং আজ তা-ই করবে সে। এমনও হতে পারে বড় ভাই কামাল ও তার স্ত্রী রেহানা নিজেদের মতো করে ইনিয়ে-বিনিয়ে দেশে তাদের সব আত্মীয়স্বজনের কাছে এর মধ্যে বলে ফেলেছে। আবার আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসরত দুই বোনের নিকটও ফোনে বলে থাকতে পারে। একমাত্র আলমগীর মামাই এমন একজন মানুষ, যার কাছে বলার সাহস তাদের হবে না।

 

ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমান সবার ছোট। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর ভাইবোন সবাই চারতলা বাড়িটির অংশীদার হলেও বাড়িটিতে বসবাস করে শুধু আমান আর কামাল। বোনেরা স্বামীগৃহে সবাই অবস্থাপন্ন, তবুও পিতৃসম্পত্তিতে তাদের প্রাপ্য ভাগ করে নিয়েছে। বাড়িটির কিছু অংশও পেয়েছে। এখানে বোনেরা না থাকলেও সময়মতো ভাড়ার টাকা তারা পেয়ে যায়। বোনেদের পক্ষের সার্বিক কাজ আমানই করে। এছাড়া কোন প্রকার লিখিত-পড়িত না থাকলেও বাবার পরে সর্বশেষ মায়ের মৃত্যুর পর বাড়ির দেখাশুনাও তাকেই করতে হয়। কামাল প্রায় সারামাসই ব্যবসার কাজে দেবিদ্বার থাকে। সঙ্গত কারণে তার পক্ষে বাড়ির দেখাশুনা সম্ভব হয় না, অথবা দেখাশুনার কাজে তার ভেতরে কোনরূপ উৎসাহও জাগে না। এছাড়া হয়তো মনে করে থাকতে পারে আমান তো ঢাকায়ই আছে, আর যেহেতু সে স্ব-উদ্যোগে সবকিছু দেখছে, সুতরাং এ নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তবে রেহানা ঠিক এর উল্টো, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাড়ির প্রায় সবকাজেই নাক গলাতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু আমানের এসব যে অপছন্দ, তা জেনেও সে পিছপা হয় না। বাড়ির মালিকানা তাদেরও, সুতরাং কামাল উদাসিন হলেও স্ত্রী হিসেবে দেখভালের একটা দায়িত্ব অবশ্যই তার আছে- বিষয়টি এমন। কামাল বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অনেক সময় দু’জনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়, শেষমেশ না পেরে রেহানা উম্মাদের মতো আচরণ করে। জিনিসপত্র ভাঙচুর করে সংসার অশান্ত করে তোলে। গোয়ার্তুমিটা এমন পর্যায়ে যায়, শেষে কামালকে শান্ত গোবেচারার মতো পিছু হটতে হয়। রেহানার এহেন উদ্ভট আচরণের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের সবাই কমবেশি পরিচিত এবং কারণে অকারণে মুখোমুখি হলে তারা কথা বলে ঠিকই, কিন্তু তাকে ভালো চোখে দেখে না কেউই।

 

আলমগীর মামার বিশাল ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে জুত হয়ে বসে আমান। মামা বললেন, কী এমন আলাপ, যার জন্য এত রাত করে তুমি আসলা?

 

আমান যে কথা বলার জন্য এসেছে শুরুতেই তা না বলে রেহানার পূর্ব-কীর্তিকলাপের কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করে। বিয়ের কিছুদিন পর বাপের বাড়ির কেউ একজনের সঙ্গে পরকীয়া না ঠিক কি একটা কেলেঙ্কারিতে রেহানাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল কামাল। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বিশাল এক হাঙ্গামা চলছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। কিছুতেই নিবৃত করা যাচ্ছিল না কামালকে। শেষে ওর বড় মামার হস্তক্ষেপে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। রেহানাকে ঘরে তুলতে বাধ্য হয় কামাল। অথচ সেই বড় মামার মৃত্যুর পর লাশটা পর্যন্ত দেখার সময় হয়নি রেহানার।

 

ঘটনার বর্ণনা শেষে আমান আলমগীর মামার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আপনিই বলেন মামা, কত বড় জালেম হলে এমনটি করতে পারে একজন!

 

মামা বললেন, সে কি আর আমি জানি না মনে করছো?

 

বাড়ির কেয়ারটেকার মতি মিয়াকে রেহানার অপছন্দ। ব্যাটার শুকনো শরীরে নাকি চর্বি জমেছে, কোন কথা গায়ে মাখে না। সময়মতো ডাকলে পাওয়া যায় না। দিনভর শুধু নাকি তামান্নার কাজেই ব্যস্ত থাকে। কত বড় হিংসুটে! বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ির কারোর সঙ্গে আলোচনা না করে একদিন মাগুরা থেকে কামালকে দিয়ে খালেক নামের আরেকজনকে বাড়িতে এনে ঢোকায় রেহানা। মতি মিয়া পুরোনো লোক। মা জীবিত থাকতে আমানকে বলেছিল মতিটা খুবই বিশ্বস্ত, ওকে যেন না তাড়ায়। সেই মতি মিয়াকে বিনা কারণে বাদ দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে এলো! অগত্যা কি আর করা, মায়ের আদেশমতো মতি মিয়াকে নিজের জিম্মায় রেখে দেয় আমান। এক বাড়িতে এখন দুইজন লোক, খরচ হচ্ছে অতিরিক্ত।
মামা, কামাল ভাইকে আমি মা’র কথাটা বললাম পর্যন্ত, কিন্তু সে বউয়ের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিলো।

 

আলমগীর মামা মাথা নেড়ে বললেন, হু, কি করবা বলো, কামালতো এখন বউয়ের ন্যাওটা হয়ে গেছে!

 

কামালের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটি বড়। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্র পক্ষের লোকজন আসবে মেয়ে দেখতে, বাড়িঘর দেখতে। ত্রিশ বছর আগের পুরোনো বাড়ি। আর যাই হোক, অন্তত নিজেদের ফ্ল্যাটটি সংস্কার না করলে রেহানার যেন ইজ্জত আর থাকে না! যেমন পরামর্শ, ব্যবসার পুঁজি ভেঙে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে দুই মাস লাগিয়ে পুরো ফ্ল্যাট ভেঙেচুরে ঠিকঠাক করে কামাল। পরে আবার হঠাৎ মনে হয় সিঁড়িটাও পুরোনো, সেকেলে। এটি আর এখন ফ্ল্যাটের সাথে যায় না, অন্তত নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত কিছুটা দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন। কারোর সঙ্গে কোন আলাপ-আলোচনা নেই, এমন কি আমান যে একই বাড়িতে থাকে তার সঙ্গেও না। হুট করে একদিন লেবার ডেকে ধুমধাম সিঁড়ি ভাঙা শুরু করে। এজমালি বাড়ি। ঘরের ভেতরে মনমতো ভাঙচুর করা গেলেও বাড়ির বাইরের অংশে যে এটি করা যায় না তা কামালকে অনেক করে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আমান। নিরুপায় হয়ে কাজে বাধা দিলে শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে গভীর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

 

বলেন মামা, এ কাজটা করা কি ঠিক হয়েছে?

 

আলমগীর মামা বললেন, কামাল একটা বেওকুফ। কি আর করবা, শেষ পর্যন্ত তো আমাকে গিয়েই মিটমাট করতে হলো।

 

এলাকায় ওয়াসার নতুন ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। সাপ্লাইয়ের পানিতে প্রচুর আয়রণ আর মাটির ময়লা। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির পুরোনো ওয়াটার রিজার্ভার নোংরা কাঁদায় ভরে যায়। ভাড়াটেদের তো বটেই, তামান্না বলেছে পানি ব্যবহারে তাদেরও খুবই অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু অফিসের কাজে ট্যাংক পরিষ্কারের সময় হচ্ছিল না আমানের। একদিন ছুটির দিনে মতি মিয়া আর খালেককে সঙ্গে নিয়ে ট্যাংক পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয় আমান। কিন্তু রেহানা খালেককে নিষেধ করায় সেদিন আর কাজটি করা হয় না। অযুহাত কি, কামাল এখন ঢাকায় নেই। আসলে পরে দেখা যাবে। মেজাজ খারাপ হলেও এ নিয়ে কামাল কিংবা রেহানা কারোর সঙ্গেই কিছু বলেনি আমান।

 

আপনিই বলেন মামা, বাড়ির প্রতিটি বিষয়ে এমন করলে কাহাঁতক সহ্য করা যায়!

 

আলমগীর মামা এতক্ষণ মাথা নিচু করে আধবোজা চোখে সব শুনছিলেন। এবার মাথা তুলে বললেন, ভাগিনা, এগুলো বলতে তো তুমি এত রাত করে আমার বাসায় আসোনি। আসল কথাটা কও দেখি এবার।

 

আমান মলিন মুখে বলল, মামা, আপনিতো আমাদের ফেমিলির বিষয়ে প্রায় সবই জানেন। ভাবির আচরণে আমার তো এখন বাড়িতে বসবাস করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। গতকালের ঘটনাটা বলতেও আমার লজ্জা করছে। আপনি হয়তোবা এর মধ্যে জেনেছেন। এমনও হতে পারে ভাই আর ভাবি বাসায় না এলেও ফোনে আপনার কাছে আমার নামে একগাদা নালিশ করে ফেলেছে।

 

না, ওরা আমাকে কিছু জানায়নি। তবে তোমার বোন ঝর্ণা মোহাম্মদপুর থেকে ফোনে আমাকে কিছুটা বলেছে। তুমি এখন পরিষ্কার করে বলতো ঘটনাটা।

 

আমান এবার ঘটনার পুরো দৃশ্য আনকাট অবস্থায় আলমগীর মামার কাছে বর্ণনা করে।

 

দুই দুইজন কেয়ারটেকারের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচের পরও বাড়িটা দিকে কারো কোনো নজর নেই। যেটুকু বলা হয় তার বেশি নিজ থেকে একজনও কাজ করে না। বাড়িটা নোংরা আবর্জনায় ভরে গেছে। সাফসুতুর করার কোন উদ্যোগ নেই। সেদিন বিকেলে আমান বাড়ির পেছনে ঘুরতে গিয়ে দেখে দেয়ালের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত শ্যাওলা জমে আছে। বেশ কিছু পরগাছাও বড় হয়ে সেনেটারি পাইপ লাইনের ফাঁকে ফাঁকে দেয়ালের প্লাস্টারের ভেতর থেকে ঝুলে আছে। আবার কয়েক স্থানের প্লাস্টার ফেটে ইটের গাঁথুনি পর্যন্ত বের হয়ে গেছে। দেখেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠার উপক্রম হয় আমানের। তিরিক্ষি মেজাজে মতি মিয়াকে ডাকতেই দৌঁড়ে ছুটে আসে সে।

 

মতি মিয়া, তুমি কই থাক? যাও, খালেক মিয়ারে আসতে বল। বদমাইশের চ্যালা, ঘরে বসে খায় আর ঘুমায়!

 

খালেক মিয়া সামনে আসতেই আমানের মেজাজ আরেক দফা বিগড়ে যায়। জামাকাপড় পড়ে ফুলবাবু সেজে আছে সে।

 

এই, তুমি কি কর? তোমার কি কোন কাজকর্ম নাই?

 

খালেক মিয়া বলল, ক্যান দাদা, সারাদিনই তো কাম করি।

 

কাম কর মানে? বলেই দেয়ালের দিকে আঙ্গুল তুলে আমান আবার বলল, এইগুলি কি? তোমার চোখে পড়ে না?

 

আমানের মেজাজের দিকে কোনই ভ্রুক্ষেপ করে না খালেক মিয়া। সে ঠাণ্ডা মাথায় বলল, বাড়ির পিছনে, এইগুলান আমার কাম না দাদা।

 

তোমার কাম না মানে? খালেক মিয়ার কথায় আমানের মেজাজ আবারো সপ্তমে ওঠে, এইগুলি কি মতি মিয়ার কাজ? মতি মিয়া তো শুধু আমার ঘরের কাজ করে। আমি একাই তাকে আলাদা করে বেতন দেই। তোমাকে তো রাখা হয়েছে পুরা বাড়ির দেখাশুনার জন্যই, নাকি? কথার পিঠে কথা বল, বেত্তমিজ! দক্ষিণ পাশে গ্যারেজের কোণাটার মধ্যে ময়লা কেন? সবসময় পানি জমে থাকে, দেখ না? ঐটা তো বাড়ির সামনের কাজ, নাকি?

 

আমানের চড়া স্বরের কথা খালেক মিয়ার পছন্দ হয় না। বলল, দাদা, আমি আর এই বাড়িত কাম করতাম না। আইজই চইল্যা যামু।

 

বলেই সে নিচতলায় গ্যারেজের কাছে তার ঘরের ভেতরে গিয়ে গরগর করতে করতে কাপড়চোপড় গোছাতে থাকে। অল্পক্ষণ পর আমান তিনতলায় উঠার জন্য সিঁড়ির গোড়ায় পা রাখতেই খালেক মিয়ার উচ্চৈঃস্বরের গরগরানি আর ব্যাগ গোছানোর কসরত দেখে চোখমুখ লাল হয়ে যায় তার।

 

খালেক মিয়া, বেশি বাইড়ো না বললাম!

 

খালেক মিয়াও কম যায় না, বাড়াবাড়ির কি আছে? আমি থাকতাম না। আমারে কি জোর কইরা রাখবেন? একলা মানুষ, এত কাম করতে পারতাম না। সারাদিন কুত্তার লাহান দৌড়ান লাগে! তারপরেও মেজাজ দেখাইয়া কথা কন।

 

ঠিক এ সময়ে রেহানা দোতালা থেকে একরকম উড়ে নিচে নেমে এসে খালেক মিয়ার সামনে দরজার কাছে দাঁড়ায়। দরজার সামান্য দূরে গ্যারেজের ভেতর দাঁড়ানো আমানের দিকে না তাকিয়ে বলে উঠে, খালেক মিয়া, কি হয়েছে? এত চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন? তোমাদের জন্য কি বাড়িতে ভদ্রভাবে বসবাস করতে পারব না? বাইরের লোকজন কি বলবে? এই, তুমি কাপড়চোপড় গোছাচ্ছ কেন?

 

খালেক মিয়া কালো মুখে বলল, ভাবি, আমি আইজই চইল্যা যামু।
কেন, কী হয়েছে?
ছোট দাদারে জিগান।
ছোট দাদারে জিগাবো মানে! তোমারে কি ছোট দাদায় এনেছে, না আমি এনেছি? বাড়ি তো হের একলার না। আমার কথা ছাড়া তুমি এক পা-ও নড়বা না। ইস্, যা মন চায় তা-ই করব, মাতব্বর হইয়া গেছে, না!
রেহানার কথাগুলো কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা আমানের শরীরে কাঁটার মতো বিধঁছিলো। মেজাজ হারিয়ে ফেলে সে চিৎকার করে বলে উঠে, এই তুমি আমাদের মধ্যে কথা বলতে আসলা কেন? তারপর ধমকের সুরে বলল, যাও, এক্ষুনি উপরে যাও?
রেহানাও কম যায় না। বলল, না, আমি যাব না। কি করবা তুমি?

 

আমি কি করব দেখবা? বলেই আমান অনেকটা ভয় দেখানোর জন্য গ্যারেজের ভেতর থেকে কাঠের টুকরো কিংবা অন্য কিছু একটা হাতে তুলে নেয়ার পায়তারা করতেই রেহানা পা থেকে জুতা খুলে আমানের উপর ছুঁড়ে মারে। তারপর রাগে গরগর করতে করতে দোতালায় উঠার জন্য সিঁড়ির পাটাতনের উপর গিয়ে দাঁড়ায়। ছুঁড়ে মারা জুতাটি আমানের গায়ের উপর গিয়ে পড়ে। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমান তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। চোখের পলকে দৌঁড়ে উপরে উঠে রেহানাকে ধরে চড়-থাপ্পড় দিতে থাকে। দু’জনের মধ্যে শুরু হয় অশালীন, অশ্রাব্য বকাবকি আর ধ্বস্তাধ্বস্তি। নিচে সিঁড়ির গোড়ায় বেকুবের মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে মতি আর খালেক মিয়া। একটা ভূমিকম্পে যেন সমগ্র বাড়িটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। হইচই আর ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনে তামান্না আর কামাল উপর থেকে দ্রুত ছুটে নিচে নেমে আসে। ধরাধরি করেও ঠিক যেন অসুরের শক্তিতে বলীয়ান কাউকেই বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। শেষে জোর করে একপ্রকার টেনেহিচঁড়ে দু’জনকে ছাড়িয়ে ঘরে নিয়ে গেলে সমস্যার আপাত নিষ্পত্তি হয়।

 

সব শুনে বিষ্মিত হন আলমগীর মামা, এতদূর!
ঘটনার বিবরণ শেষে আমান আবার পেছনে চলে যায়। দুঃখ করে বলে, অনেক কথা আছে আমি বলি না। দেখেন মামা, ফ্ল্যাটের সংস্কারের কাজ করে কামাল ভাই আর্থিক অনটনের মধ্যে আছে মনে হয়। গতবছরের কুরবানির ভাগের টাকা এ বছর দিয়েছে। এবারেরটা এখনো দেয়ার নাম করে না। আমি কিছু বলতেও পারি না। আবার দেখেন, সে যে সমস্যায় আছে সেকথাও বলে না।

 

বলো কি! আলমগীর মামার বিষ্ময়ের ঘোর কাটে না, সমস্যা থাকলে কুরবানির কি প্রয়োজন? আচ্ছা কামালের কি বোধশক্তি সব লোপ পেয়েছে? তুমি কথা বলছ কেয়ারটেকারের সঙ্গে, এখানে রেহানা আসবে কেন? কামালতো ঘরেই ছিল, আসলে সে-ই আসত!

 

আমান বলল, তাহলে তো আর এই ঘটনা ঘটত না মামা। আমি খুবই আপসেট ছিলাম, আপনার কাছে বলে এখন একটু হালকা হলাম। মামা, তোমার পকেটে যে টাকা নাই কোন কাজ করার আগে সেটি ভাববা না? কামালকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে আমান আবার পেছনে ফিরে যায়, ব্যাংক লোনের টাকা দিয়ে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে। গায়ে হলুদের জন্য বুকিং দিয়েছে রাওয়া ক্লাবে, বিয়ের অনুষ্ঠান করবে অফিসার্স ক্লাবে। দেবিদ্বারেও বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাংক লোনের কোন খবর নাই। একদিন দেখি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তোমরা কি তোমাদের ওজন বোঝো না? নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা করতে হবে? কি দরকার ছিলো রাওয়া ক্লাবে হলুদের অনুষ্ঠান করার? এ কাজটিতো বাড়িতেও করা যেত। ঢাকায় অনুষ্ঠানের পর দেবিদ্বারে গিয়ে শত শত মানুষ খাওয়ানোর কোন প্রয়োজন ছিল? মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কাছে নিজেদের এমন হ্যাডম্ জাহিরের কোন দরকার আছে বলেন। জানেন মামা, এর জন্য শেষ পর্যন্ত বিশ লাখ টাকা দামের জমি অর্ধেকে বিক্রি করতে হয়েছে।

 

ভেতরের এতসব খবর আলমগীর মামা জানেন না, অবশ্য তার জানারও কথা না। নাতনির বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন, ঝাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে প্রীত হয়েছেন। কিন্তু আজ আমানের মুখে শুনে কামালের প্রতি তার আফসোসের সীমা পরিসীমা থাকে না। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কামাল না হয় উজবুক, কিন্তু রেহানারও তো স্বামীর অবস্থা বোঝা প্রয়োজন ছিল।

 

আমান বলল, মামা, ঐটাই তো সমস্যা। পরিকল্পনা তো সবই তার। মহিলাটা যদি বুঝতো তাহলে কি আমার সঙ্গে এমন একটা অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হতো? কেয়ারটেকারের সঙ্গে বাড়ির কাজ নিয়ে কথা বলছি আমি, তোমার এখানে নাক গলানোর দরকার কি?

 

আলমগীর মামা দুঃখ করে বললেন, আজ আমার তোমার মায়ের একটা কথা খুব মনে পড়ছে ভাগিনা। অনেকদিন আগে তোমাদের দুই ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, আমানটা খুব বৈষয়িক। আর কামাল, তার খৈল্তার তলি ছিঁড়া। বউটাও পড়েছে এমন, তার যে কী হবে আল্লাই ভালো জানেন! তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রাত বেশি হয়ে গেছে; যাও, বাসায় গিয়া ঘুমাও। আর শোনো, এগুলি হলো ময়লা-আবর্জনা, বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করবা না। আর কামাল যদি কখনো আমার সঙ্গে কথা বলে, তাহলে তাকেও আমি এই পরামর্শই দেব। #

 

ahsanwahid5262@gmail.com

Print Friendly

Related Posts