পর্ব-১
তুয়া মনি নানীর কোলে মুখ লুকিয়ে গল্প শুনতে থাকে। রাজার কুমার আর পক্ষী রাজার গল্প কতই না মধুর। তবে আজ কাল ফিক্শন জাতীয় বই পড়তে খুবই আগ্রহী। নানীর কোলে মাথা রেখে প্রতিদিন ঘুমায়। এক পর্যায়ে বাগানে বেড়াতে চায়।
বাগানে সুন্দর সুন্দর সবুজ গাছে গাছে কাঠবিড়ালী লাফালাফি করতে থাকে। এ গাছ থেকে ও গাছে ঝাপ দেয়। ছোট বাঁকা লেজসহ ছোট ছোট পা দিয়ে উড় উড় করে দৌড় সত্যি কাঠবিড়ালী চমৎকার প্রাণী। তুয়ার সাথে সাথে রয়না বুয়া কাজ করতে থাকে। নানীমা সন্ধ্যায় পড়ার কথা বলে। সন্ধ্যার আকাশে দূরে ধ্রুব তারা যেন তাকিয়ে থাকে। একমনে খেলতে খেলতে ফুলবাগানে যায়।
মালি আব্দুল মাটি খুড়তে খুড়তে মাটির নিচ থেকে একটি কাঠবিড়ালের মতো প্রায় কংকাল বের করে। তুয়া মনি এতো দিন জীবন্ত কাঠ বিড়ালী দেখেছে। আজ এই কংকাল দেখে মনের মাঝে কেমন যেন দুঃখ দুঃখ ভাব হয়ে যায়। গল্পে কত রকম জন্ম মৃত্যুর কথা শোনে কিন্তু মন খারাপ হয় না। কিন্তু আজ মালি আব্দুলের মাটি খুড়ার মাঝে প্রাপ্ত কংকালটা মনে বড় পিড়া দেয়। একদিন এই জীবেরও প্রাণ ছিল। গাছের একডাল থেকে অন্য ডালে ঘোরাঘুরি করতো কত, কত না আনন্দের ছিল। আজ যেন ব্যথা-বেদনা স্মৃতির পাতায় লেখা হয়ে আছে। হাস্যেজ্বল জীবনের পাতায় একি রহস্য। যে রহস্য তুয়াদের মতো কিশোরীর মনের কোনে কৌতূহলসহ বেদনা দেয়।
এ বেদনা এক নতুন সৃষ্টি জাগরনী, দূর অজানা সৃষ্টির এক রহস্যময় উদ্দীপনা, হয়তো এই ব্যথাতুর রহস্যের মাঝে অজানা এক উজ্জ্বল রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে। নতুন কোন সৃষ্টির উন্মোচন ঘটবে। তুয়ার মতো নির্মল কিশোরী অজানার পথে উকি মারবে।
পর্ব-২
তুয়া মনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ওর ছোট বোন ছায়াও কংকালটা দেখতে চায়। দেখতে দেখতে মায়া, রাখি, আসিফ, সবাই এগিয়ে আসে। কংকালটা অবশেষে আব্দুল ভাল পানি দিয়ে ধুয়ে তুয়ার ভাইয়া আসিফের হাতে দেয়। আসিফ নিজে তুয়াকে দেখায়। তুয়া বিজ্ঞের মতো নেড়ে চেড়ে দেখে বলে, কংকালটা কোন আজিব জন্তুর ফসিল হবে।
তুয়া কিছুদিন পূর্বে ড্রাগনের ফসিল দেখেছিল। তা ড্রাগন আবার মুখ দিয়ে আগুন বের করে। ড্রাগনের মুখের আগুনে সেই অতীত কালে সব পুড়ে ছাড়খার হয়ে যেত। আসিফ স্টাডি রুমের শো-কেসের মধ্যে খরগোশ কিংবা অন্য কোন জন্তুর ফসিলটা সযত্নে সাজিয়ে রাখে।
তুয়া, ছায়া, মায়া, আসিফ, সাকিব, তূষার ওরা ভাই-বোন। ওদের সংসারে ওরা নানা রকম বই পত্র তো পড়ে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। ওরা সেই সব বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবসহ বৈজ্ঞানিক জিনিস পত্র উৎসাহের সাথে আলাপ আলোচনা করে। নানীমা ছোট বেলার গল্প শোনাতো। কংকালে আছে কোন কিছু নতুন অজানা রহস্য উন্মোচন। ওরা ঝাপিয়ে পরে। আজ কংকালের মতো ফসিল জাতীয় বিষয় নিয়ে সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। সবাই ঐ দিকে খবরদারি করে। ফসিল জাতীয় বিষয় ওদেরকে কোন অজানা আহবানে দূর-দূরান্তে নিয়ে যাবে। তবে তুয়ার মেধা অত্যন্ত প্রখর, যা কিনা আসিফ, সাকিব থেকে প্রখর।
তুয়ার বাবা সবার থেকে তুয়াকে ভালবাসে। অজানকে জানার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। অদেখাকে দেখার জন্যও বটে। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মেধার স্ফূরণ ঘটুক তা অভিভাবক মন্ডলী চেয়ে থাকেন।
পর্ব-৩
তুয়া গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। একসময় পড়াশুনা শেষ করে রাতের ডিনার খেয়ে নিজ ঘরে নানী মার কাছে ঘুমাতে যায়। আজ আর নানীর গল্পে মন ধরে না। ডাইনোসরের ফসিল ওর চোখে যেন ভেসে ওঠে। নানীর কোলে যদিও ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু ও যেন কার মিষ্টি ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওর বয়সী একজন সুন্দর মেয়ে নাম তার রূপ রেখা, তুয়াকে ডাকে। তুয়া নাম জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি হেসে বলে, রূপ রেখা।
তুয়া রূপ রেখাকে বলে, তা তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
রূপ রেখা বলে, তুমি তুয়া আমার নতুন বান্ধবী। তুমি আমার ফসিল দেখে অনেক চিন্তিত। আর তাই আমি তোমাকে চিন্তা থেকে মুক্তি দেব। তুমি অনেক কিছু জানতে চাচ্ছো? আমি তোমাকে জানাবো। এই চকচকে সাদা আর ধূসর পাথর নাও। ধূসর দিকে তুমি টিপ দিলে অনেক কিছু নতুন দেখতে পাবে আর সাদা দিকে টিপ দিলে পুরাতন অবস্থায় চলে যাবে। এই পাথরটিকে যাদুর পাথর বলে। আমার একটা মন্ত্র পড়া দিয়ে পাথরটি উদ্ধার করা হয়েছে।
তুয়া খুব খুশি হয়ে যায়। এ রকম একটি ফসিল ও তার ফিক্শন তুয়া মনে মনে আশা করেছিল। যা দিয়ে ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে। আজ তুয়া যেন রূপ রেখা আর পাথর দুই পেয়ে অবাক হয়ে গেল। সে রূপ রেখাকে তার জীবন সর্ম্পকে জানতে চাইলো।
রূপ রেখা বলে, সে ওদের মতো। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ সকল গোত্রে ছিল। সেই গোত্রে একদিন দুঃখ বেদনা আছে। আর তাই জীবনের চলার পথে বৈজ্ঞানিক সাধনা আর দৈব শক্তি অর্জন করলো। আর দৈব বর ও সাধনা তাকে যেন অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেল। মানুষের উন্নতি শুধু না, অনেক ভালো কাজে রূপ রেখা এগিয়ে গেল। আজ সেই দৈব শক্তির বলে তুয়া নামক কিশোরীর সাথে দেখা হয়, কথা হয়।
রূপ রেখার খুব ভাল লাগে যে আজ ও তুয়া নামক কিশোরীকে যাদুর পাথর দিয়ে উপকার করতে পেরেছে। যাদুর পাথর তুয়াকে অনেক রকম বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। যাদুর পাথর তুয়াকে নতুন দিগন্তে নতুন সম্ভাবনায় এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই মুহুর্তে রূপ রেখা পথের সাথি হয়ে গেল।
তুয়া বরাবর নানী ঘেষা ছিল। নানী সব সময় তুয়াকে অনুপ্রানিত করতো। আকাশে বাতাসে যত রকম ঝড় ঝাপ্টা তার সম্পর্র্কে তুয়া নানীর কাছে জানতো। এই জানা জানির এক পর্যায়ে অজানার পেছনে কৌতূহল। এই কৌতূহল তাকে অদম্য আকাঙ্খা জানায় তার যদি দুইটি পাখা থাকতো তবে পাখা দিয়ে দূর-দূরান্তে উড়ে যেত। সাঁঝ আকাশের কৌতূহল যেমন আকষর্ণ করতো তেমনি রাতের অন্ধকার তাকে নির্ভয় কৌতূহল জানাতে ভোরের আধা আলো আধা আলো ওকে অনেক কৌতূহল জাগাতো। ভোর বেলার শুক তারা তার মনে আলোড়ণ জাগিয়ে দেয়। ছোট মন নিয়ে উড়ে বেড়ায়, আকাশের অজানা মেঘের তরে তরে। পরম উদ্দীপনায় মন ভরে উড়ে বেড়ায়।
পর্ব-৪
রূপ রেখা তুয়াকে হাত ধরে দূরে যেতে থাকে। তুয়াদের বাগান বাড়িটাতে তখন স্তদ্ধতায় নিমজ্জিত ছিল। মাথার উপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে কি যেন উড়ে যায়। তুয়া ভয় পেয়ে যায়। রূপ রেখার দেওয়া যাদুর পাথর তার হাতে। ইচ্ছে করলে সে বর্তমান অবস্থা বা পরিবেশটা পরিবর্তন করতে পারে। তুয়া অনেক ভয় পেয়েছে কিন্তু যাদুর পাথর ব্যবহার করে না। সে রূপ রেখার সাথে দূরে হাঁটতে থাকে।
একসময় রূপ রেখাকে প্রশ্ন করে, মাথার উপর দিয়ে কি উড়ে যায়?
রূপ রেখা বলে, ভয় পেয়ো না তুয়া মনি আমাদের মাথার উপর দিয়ে ভূত পাখি উড়ে যায়।
ভূত পাখি উড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রূপ রেখা বলে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ভূত পাখির কাছে আমরা কত থেকেছি। ওরা কখনও আমাদের ক্ষতি করেনি। আমরা ভূত পাখিকে অনেক সময় অভিভাবক মনে করতাম। আমরা কতদিন গাছের গুড়িতে যখন দৌড়ে যেতাম ভূতপাখী যেন মায়ের মতো শাসন করতো। আমাদের যেন অভিভাবক ছিল। আমরা নাচতে নাচতে বকা খেতাম। দূর-দূরান্তে চলে যেতাম। দিন থেকে রাতে আমাদের উৎপাত বেশি ছিল। আমরা আঁধারকে ভয় পেতাম না। দিনের আলোতে তোমাদের মতো মানুষ আমাদের বিরক্ত করতো। কিন্তু তুমি মানুষদের মধ্যে থেকে ভালো মেয়ে। তোমার ভালোর জন্য তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে।
রূপ রেখা ছড়া কাটতে থাকে-
“তুয়া একটা ভাল মেয়ে-
চল আমরা যাই ধেয়ে-
দূর-দূরান্তে, মাঠে ঘাটে
কিংবা কোন ভূতের বাটে।”
তুয়া অবাক হয়ে বলে, তুমি রূপ রেখা ভূত চিনতে পারো।
রূপ রেখা অবাক হয়ে বলে, ভূত আবার কে চেনে না। ভূত তোমার দেশ আমার দেশ সব দেশে থাকে। সব দেশের মাঝ দিয়ে ভূত উড়ে যায়। কখনো বাসা বেঁধে থাকে। দূরে গহীন জঙ্গলে যেমন ওরা মজা করে থাকে তেমনি তোমাদের শহরেও ওরা থাকতে চায়। তোমাদের মতো মির্ষ্টি মেয়ে যেন ওদের পছন্দ। ওরা মানুষকে ছুয়ে ছুয়ে যায়। মানুষের রূপ রেখা ওদের কাম্য। ওরা তাছাড়া পোড়ো বাড়ীতে ঘুরে বেড়ায়। পোড়ো বাড়ীর খসে যাওয়া ইট আর অনুজ্জল আবছায়া আলো ওদের বেশী পছন্দ। আর তাই ওরা ভালবাসে নিঝুম এলাকা। নিঝুম এলাকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় দূর আকাশে ওরা ওদের জীবনকে শত দীর্ঘ দিবসের খাতায় নাম লিখেছে। তাই ওদের বয়স সীমাহীন। ওরা অসীম ভাবে সীমাহীন খেলায় মেতে উঠে। ওরা নির্ভীক চঞ্চল। ওদের মধ্যে বাস করে এক প্রপাকান্ড প্রবাহ।
পর্ব-৫
তুয়া ভীষণ ভয় পেয়ে রূপ রেখার হাত ধরতে যায়। রূপ রেখা সরে যেয়ে বলে, আমার শরীরে তুমি হাত দিবে না। হাত দিলে ভয় পাবে। ঐ দূরের আকাশে যেমন চাঁদকে দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। অতএব আমাকে তুমি অনেক কাছে মনে করলেও আমি তোমার থেকে অনেক দূরে। তুমি আমার দেশ দেখতে চাইলে বলবে,
“রূপ রেখা রূপ রেখা
পথ তোমার আঁকা-বাঁকা
দেখতে চাই তোমার দেশ
বলবে সবাই বাহবা বেশ।”
তুয়া খুব খুশি হয়ে বলে, বাহ্ তুমি আমার নানীমার মতো বাংলা ভাষায় ছড়া কাটতে পারো। রূপ রেখা হেসে বলে, বারে আমি ছড়া বাংলায় পারি কারণ আমার এই দেশ বাংলায় কথা বলতে পারে। আমাদের পূর্ব পুরুষও বাঙালি ছিল। আর তাই আমরা বাংলা ভাষা পছন্দ করি।
তুয়া অবাক হয়ে যায় বলে, বাংলাদেশের পশু পক্ষিরা বাংলায় কথা বলতে পারে। রূপ রেখা বলে, এই বাংলার আকাশ বাতাসে কি হয় না। আমরা আমাদের যাদুর মধ্যে দিয়ে আমাদের রূপ পরিবর্তন করতে পারি।
রূপ রেখা বলতে থাকে
“তুয়া মনির জন্য
প্রথম রূপ গণ্য।”
রূপ রেখা বলে, তুয়ার কাছে রূপ রেখা একজন এমন বান্ধবী যে কিনা যাদুর পাথর দিয়েছে। এই যাদুর পাথর সংগ্রহ করতে রূপ রেখাকে বহুত সাধনা আর ভাল কাজ করতে হয়েছে। রূপ রেখা পূর্ব জন্মে কি ছিল জানে না। একবার এক দৈব শক্তির বুড়িকে সে অনেক সেবা যত্ন করেছিল। সেবা যত্নের সময় বুড়ি অনেক খুশি হয়। বর দান করে, সাথে সাথে তার হাতে যাদুর পাথর চলে আসে। এরপর যতবার বিপদে পড়েছে, যাদুর পাথর ঘষাতে রক্ষা পেয়েছে। দূর-দূরান্তে দিগ-দিগন্তে হাওয়ায় হাওয়ায় যাদুর পাথর সাহায্য দান করেছে। এখনও করছে।
তুয়া বলে, তা ভাই রূপ রেখা তুমি যাদুর পাথর আমাকে দিয়ে দিলে তা তুমি তোমার বিপদে কি করবে?
রূপ রেখা বলে, আমার দেহের অংশ তোমার ঘরে আছে। তাতেই চলবে।
ঐ দিন তোমার কৌতূহল আমাকে তোমাদের বাগানে ফসিল করে রেখেছে। ফসিল দূর-দূরান্তে নানা জায়গায় নানা জনের নানা প্রাণী হয়ে ঐতিহাসিক ভাবে সংরক্ষিত আছে। এই সব জীবের একদিন প্রাণ ছিল। মৃত্যুর অজানা ঠিকানায় পৌছে যাওয়ার পরে ইতিহাস তাদের নিজস্ব ফাইলে বন্দী করে রেখেছে। ইতিহাস বন্দী ফসিল পৃথিবীতে তাদের অতীতের স্বাক্ষর যেন বলে যায়। মানুষের ব্যথা বেদনা নিয়ে ছুটে ছুটে যায় অতীত ইতিহাসের কাছে তেমনি অতীত যেন হাত ছানি দিয়ে ডাক দেয়। ইতিহাস যেন মানুষের ফসিলগুলি তুলে ধরে। তার সাথে বিভিন্ন জীবনের ফসিল ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়ে যেন কথা বলে।
রূপ রেখা বলে, “ আমিও একদিন মাতৃ জঠরে ছিলাম তোমাদের মতো।
তোমাদের সাথে এই একটি শুধু না, অনেক মিল বা সাদৃশ্য আমাদের মতো প্রাণীদের। আমরা নিজ ভাষায় যেমন কথা বলি অন্য ভাষায় তেমনি মন খুলে কথা বলতে পারি ও বুঝতে পারি।
বলতে পারো তুয়া মনি এই পৃথিবীতে ভাষা কত প্রকার।
তুয়া মনি বলে, আমি জানি না।
(চলবে)