নিউইয়র্কে ‘বহুবচন’ এর চমকপ্রদ আয়োজন

বিশেষ প্রতিনিধি  আরেকটি অনবদ্য আয়োজন। নিউইয়র্কের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘বহুবচন’ এর আয়োজনে ১৫ মে ২০১৬ রোববার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হলো আরেকটি চমৎকার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে তিনটি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা ছাড়াও ছিল কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠ।

জ্যামাইকার একটি মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হয় এই অনুষ্ঠান। কবি ফকির ইলিয়াসের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সাহিত্যের শিল্পঋণ’, কবি তমিজ উদদীন লোদীর কাব্যগ্রন্থ ‘অনিবার্য পিপাসার কাছে’ ও কবি শামস আল মমীনের কাব্যগ্রন্থ ‘কেউ হয়তো আমাকে থামতে বলবে’ ছিল আলোচিত বই তিনটি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস ‘অনিবার্য পিপাসার কাছে’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন, কবিতা কবির ব্যক্তিগত আলোর কন্ঠস্বর। কবি তমিজ উদদীন লোদী সেই স্বরকে উচ্চকিত করে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তিনি বলেন- কবিতা তখনই পূর্ণ হয় যখন একজন কবির বেদনা-স্বপ্ন-আক্ষেপ, আপামর মানুষের পাঁজরকে ছুঁতে পারে। লোদী, তাঁর কবিতায় সেটি করতে পেরেছেন দক্ষতার
সাথে।

হাসান ফেরদৌস বলেন, কবিতা স্ট্যাটম্যান্টের বিষয় নয়। কবিতার অপর নাম শিল্পের আড়াল। এই কাব্যগ্রন্থের প্রায় সবকটি কবিতাই কবির নিজস্ব উচ্চারণে আমাদের কালের আয়না হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, দু-একটি কবিতায় কবির ভাবনা আমাকে স্পর্শ করতে না পারলেও আশির দশকের এই কবি যে, ধীশক্তি নিয়ে কবিতার বুনন গেঁথে যান- তা বুঝতে
কোনো পাঠকেরই অসুবিধা হবার কথা নয়।

‘কেউ হয়তো আমাকে থামতে বলবে’ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার কাজী আরিফ। তিনি বলেন, কবি শামস আল মমীন, কবিতার নিজস্ব মাঠের রাখাল। তিনি গণমানুষের পক্ষে যে দ্রোহের দ্যোতনা নির্মাণ করেন- তা কালের পরতে প্রতিধ্বনিত হয়। সমকাল তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক ও কালিক শব্দমালার মিশ্রণেই এই কবির হাতে অংকিত হয় কবিতা।

তিনি বলেন- শামস আল মমীনের কবিতা আমাদের যাপিত ভালোবাসার এককেটি পাপড়ির মতো।

প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সাহিত্যের শিল্পঋণ’ নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট নাট্যজন মুজিব বিন হক। তিনি বলেন, ফকির ইলিয়াস মূলত একজন কবি। এই কবির হাত দিয়ে যে প্রবন্ধগ্রন্থটি আমরা পেয়েছি, তা কবিতার মতোই সরস। ফকির ইলিয়াসের গদ্যভাষা অত্যন্ত ঝরঝরে। একটি প্রবন্ধ পড়া শুরু করলে বইটি পাঠ শেষ করেই উঠবেন পাঠক।

তিনি বলেন, এই প্রবন্ধগ্রন্থে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কাইয়ুম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর জীবন ও কর্ম নিয়ে যেমন বর্ণনা-মূল্যায়ন আছে, তেমনি আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই নিয়েও আলোচনা। ১৭টি প্রবন্ধের প্রত্যেকটি নিজ নিজ প্রবাহে উজ্জ্বল। তবে কিছু বিষয় আছে অপ্রাসঙ্গিকও। যেমন ‘আমার চারপাশে ডুবে থাকে ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম’ প্রবন্ধটি। এটি একটি আত্মগদ্য। এই বইয়ে তা আমার কাছে মানানসই মনে হয়’নি, বলেন মুজিব বিন হক।

তিনি বলেন- কবি ফকির ইলিয়াস, এই বইয়ে কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, কবি মোহন রায়হানের কবিতা নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, শামসুর রাহমানের কাব্যকর্ম
নিয়েও। কখনও কখনও তার দেয়া উদ্বৃতি আমার কাছে বেশিই মনে হয়েছে। তবে তিনি পাঠকের কাছে পার পেয়ে যাবেন এজন্য, কারণ উদ্বৃতিগুলো কবিতার। যা আমাদের কিছু শ্রেষ্ঠ পংক্তিমালা পুনরায় পাঠের সুযোগ করে দিয়েছে।

‘নিজেদের কথা’ পর্বে অংশ নেন তিন কবি-তমিজ উদদীন লোদী, শামস আল মমীন ও ফকির ইলিয়াস।

কবি ফকির ইলিয়াস এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত‌্যের খ্যাতিমান কবিদের লেখা প্রবন্ধই তাকে প্রবন্ধ লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ, দিলওয়ার প্রমুখ কবির সাহিত্য বিষয়ক গদ্যের কথা স্মরণ করেন।

কবি বলেন, আমি ফুলটাইম কাব্যকর্মী। সময়ের ২৪ ঘন্টাই আমার ভেতরে কবিতা ছায়া ফেলে অথবা আমি কবিতা খুঁজে বেড়াই।

তিনি বলেন, আমাকে গদ্য লিখতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আজ আমি তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই, যোগ করেন কবি।

কবি শামস আল মমীন বলেন, আমি আমার কবিতায় আমার জীবনের রেখাপাত ঘটাতে চেয়েছি। আমি যেমন বলেছি-‘ওদের পথ করে দাও’ তেমনি বলেছি’কেউ হয়তো আমাকে থামতে বলবে’।

তিনি বলেন, আমার কবিতা আমার সন্তানের মতো। আমি খুব ভেবেচিন্তে আমার কবিতাগুলোকে চিরকল্যাণের দোসর করতে চেয়েছি।

কবি তমিজ উদদীন লোদী তাঁর বক্তব্যে বলেন- আমি খুব ভয়ে ছিলাম তুখোড় আলোচক হাসান ফেরদৌস আমার কবিতা নিয়ে কি বলেন। তাঁর আলোচনা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমি আমার কবিতায় ধ্যান ও মনীষার সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছি সমকালকে ধারণ করে। এই সমাজ,এই প্রজন্ম,এই মাটি আমার কবিতার সাথে যুক্ত থাকুক-সে চেষ্টা করেছি অনিবার। আজীবন আমি সেই চেষ্টা করে যাবো-এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি আবারও।

অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনান- এবিএম সালেহউদ্দীন, কাওসারী মালেক রোজী,আনোয়ার সেলিম ও রওশন হাসান।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ ও অনন্যা প্রকাশনের কর্ণধার মনিরুল হক।

তিন ঘন্টা ব্যাপী অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করেন শামস আল মমীন ও মুজিব বিন হক।

Print Friendly

Related Posts