৮ বছরেও শেষ হয়নি ফারুকী হত্যার তদন্ত

‘টাকা,স্বর্ণ নিয়ে যাও, আমাদের ক্ষতি করো না’

 

‘ফারুকী সাহেব ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমাদের টাকা, পয়সা, স্বর্ণ যা লাগে নিয়ে যাও। আমি আলমারি খুলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের ক্ষতি করো না। কিন্তু ঘাতকরা তা শোনেনি। তাকে গলাকেটে হত্যা করে।’

আলোচিত ইসলামী বক্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নুরুল ইসলাম ফারুকী ৮ বছর আগে এই দিনে (২৭ আগস্ট) নিজ বাসায় খুন হন। ওই সময় ফারুকীর শ্যালকের ছেলে মারুফ হোসেনও বাসায় উপস্থিত ছিলেন। ঘাতকরা ফারুকীকে হত্যা করলেও প্রাণে বেঁচে যান মারুফ। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঘাতকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপক ফারুকী একথা বলেছিলেন বলে জানান মারুফ।

এদিকে উপস্থাপক ফারুকী হত্যার ৮ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। কবে নাগাদ তদন্ত শেষে বিচার হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে পরিবার। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জোর দাবি জানানো হয়েছে যেন তদন্ত শেষ করে মামলার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় ।

২০১৪ সালের এই দিনে (২৭ আগস্ট) রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ফারুকীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে ফয়সাল ফারুকী মামলা দায়ের করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে সিআইডি। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিলো। কিন্তু ওইদিন মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালত আগামি ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন। এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ৬২ বার সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা।

মামলা সম্পর্কে নুরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী জানান, ‘৮ বছর হলো বাবা খুন হয়েছেন। কিন্তু এখনো মামলার তদন্তই শেষ হলো না। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে এখন মামলার তদন্তে আছে সিআইডি। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হচ্ছেন কিন্তু তদন্ত শেষ হচ্ছে না। আমরা পুরো পরিবার হতাশ। এটা নিয়ে আমরা ব্যথিত।’

তিনি বলেন, ‘তবুও মামলায় ন্যায়বিচার পাবো এ নিয়ে আমরা এখনো আশাবাদী। পুরো পরিবার প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। প্রধানমন্ত্রী যদি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন তাহলে হয়তো আমরা মামলাটির বিচার পেতাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ, তিনি যেন বিষয়টি একান্তভাবে মনিটরিং করেন।’

তদন্তের প্রকৃত দোষী সনাক্ত হবে। ইন্ধনদাতারা বেরিয়ে আসবে এটাই আশা করছেন ফারুকীর পরিবার।

ঘটনার প্রত্যক্ষশর্দী ফয়সাল ফারুকীর মামাতো ভাই মারুফ হোসেন, ‘ফুপা ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ছিলেন। সেখান থেকে লোকজন হজে যেতো। তখন ছিলো হজের সময়। হজের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে অনেকে আসতেন। তাছাড়া ফুপা ওয়াজ মাহফিল করতেন। এজন্য সব সময় লোকজন বাসায় আসা যাওয়া করতো। এটা আমাদের কাছে একটা নরমাল ব্যাপার ছিলো।’

মারুফ বলেন, ‘ঘটনার দুইদিন আগে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় হজে যাবেন জানিয়ে দুইজন লোক বাসায় আসেন। ফারুকী সাহেব কাজের জন্য বাইরে যাবেন এজন্য ওইদিন তাদের সাথে কথা বলতে পারেননি। তাদের কার্ড দিয়ে পরে ফোন করে আসতে বলেন। ২৭ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে তারা আসেন। তখন আমি বাইরে ছিলাম। পরে বাসায় আসি। এরপর আমি ভিতরে গিয়ে ফারুকী সাহেবকে তাদের কথা বলি। পরে রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে আসেন তিনি। প্রথমে দুইজন বাসায় আসেন। এর ৫ মিনিট পর আরও ৭/৮ জন আসেন। তারা সোফা, খাটের ওপর বসেন। এক জনের বসার জায়গা ছিল না। এজন্য ভিতরে চেয়ার আনতে যাই। আর ফুফুকে নাস্তার বিষয়ে বলি।’

তিনি বলেন, ‘৫ মিনিট পর সেখানে গিয়ে দেখি একজন ফারুকী সাহেবের গলায় ছুরি ধরে আসেন। আরেকজন পিস্তল। আমি গেলে আমাকেও ধরে বেঁধে ফেলে। চাদর দিয়ে আমাদের হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে। আমাদের দুইজনকে নিচে বসায়। তখন ফারুকী সাহেব তাদের বলেন, ‘তোমাদের টাকা, পয়সা, স্বর্ণালংকার যা লাগবে নিয়ে যাও। আমি আলমারি খুলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের ক্ষতি করো না। আমার গলা, মুখ বাঁধা থাকায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এজন্য নড়াচড়া করছিলাম। নড়াচড়া করায় আমার মাথায় লাথি মারে। সোফার সাথে আমার মাথায় আঘাত লাগে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। সেন্স যখন আসে তখন দেখি ফারুকী সাহেবের মেজো ছেলে ফয়সাল ফারুকী আমাকে উঠাচ্ছে। ভিতরে গিয়ে দেখি ড্রয়িং রুমে ফারুকীর সাহেবের গলাকাটা লাশ পরে আছে। এই স্মৃতি ভোলার না।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে মারুফ হোসেন বলেন,‘বিচারের জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কিন্তু কিছুই হয়নি। নতুন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আসেন আর পরিবর্তন হয়। তারা এসে ডাকেন। সেদিনের কথা জিজ্ঞাসা করেন। ৮ বছর হয়ে গেলো আলোচিত মামলাটির কিছুই হলো না। তথাকথিত বিচার হবে কি না জানি না। আমরা পুরোপুরি হতাশ। ২৭ আগস্ট আসলে নিউজ হয়, প্রচার হয়। এরপর আর কিছুই হয় না। দুনিয়াতে বিচার না পেলে আল্লাহর কাছে বিচার চাইবো।’

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাত ৯টার দিকে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাতেই তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ফারুকী নিহতের ঘটনায় তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭ টার দিকে নুরুল ইসলাম ফারুকীর বাসায় কলিং বেল চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। বাসার দরজা খুললে দুই জন লোক বাসায় প্রবেশ করে নুরুল ইসলামের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে। এর কিছুক্ষণ পর আরও ৬/৭ লোক বাসায় প্রবেশ করে। বসার স্থান সংকুলান না হওয়ায় ফয়সাল ফারুকীর মামাতো ভাই মারুফ হোসেন ভেতর থেকে চেয়ার আনতে যান। সে ফিরে এসে দেখেন নুরুল ইসলামের মাথায় পিস্তল ও চাপাতি ধরে রেখেছে আসামিরা। পরে তারা বাসার সবাইকে বেঁধে নুরুল ইসলাম ফারুকীতে হত্যা করে। আসামির বাসা থেকে নগদ টাকা, মোবাইল, স্বর্ণালঙ্কার, ক্যামেরা নিয়ে যায়।

নিহত ফারুকী চ্যানেল আইয়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথে’, মাই টিভির লাইভ অনুষ্ঠান ‘সত্যের সন্ধানে’ এর উপস্থাপক ছিলেন। এছাড়া তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ছিলেন।

এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন- হাদিসুর রহমান সাগর, আবু রায়হান, আব্দুল গফ্ফার, মিঠু প্রধান, খোরশেদ আলম, রিয়াজ ওরফে ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজ, তারিকুল ইসলাম ওরফে মিঠু, কাজী মো. ইব্রাহিম, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজিব গান্ধী, জাহিদুল ইসলাম সোহাগ, বাপ্পী মিয়া, আব্দুল্লাহ আল তাসনিম, রাইসুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজ, তরিকুল ইসলাম, আলেক ব্যাপারী, মোস্তফা আহমেদ ও মোজাফ্ফর হোসেন ওরফে সাঈদ।

আসামিদের মধে প্রথম ১০ জন কারাগারে আছেন। শেষের ৬ জন জামিনে আছেন।

মামলা সম্পর্কে কাজী ইব্রাহিমের আইনজীবী শওকত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মামলার এজাহারে আসামিদের যে বয়স উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে কাজী ইব্রাহিম মিলেন না। মামলার কোনো কিছুর সাথেই তার মিল নেই। অযথা তাকে এ মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। হয়রানি করতে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts