চেক ডিজঅনার মামলায় কাউকে জেলে পাঠানো সংবিধান পরিপন্থি বলে এ সংক্রান্ত এক রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত কয়েকটি মামলা নিষ্পত্তির রায়ে রোববার (২৮ আগস্ট) এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ।
চেক ডিজঅনার মামলায় কোনো ব্যক্তিকে জেলে পাঠানো সংবিধান পরিপন্থি বলে রায়ের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেছেন আদালত।
আদালত রায়ে বলেছেন, কোনো ব্যক্তিকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। আর নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট , ১৯৮১ এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় ব্যক্তিকে কারাগারে বন্দি রাখা ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের শামিল
আদালত রায়ে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের ১৩৮ ধারা সংশোধন করে চেক ডিজঅনার মামলায় জেলে পাঠানোর বিধান বাতিল করার জন্য জাতীয় সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের ১৩৮ ধারা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত চেক ডিজঅনারের মামলা নিষ্পত্তির জন্য একটি গাইড লাইন করে দিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরো বলেন, চেক ডিজঅনার মামলায় কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানো, কারাগারে রাখা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি এবং ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের অনুচ্ছেদ ১১ এর পরিপন্থি। বাংলাদেশ-এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে চেক ডিজঅনার মামলায় কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠাতে পারে না।
আদালত উন্নত বিশ্বের উদাহরণ টেনে বলেন, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চেক ডিজঅনার মামলায় জেলে পাঠানোর বিধান নেই। এসব দেশে চেক ডিজঅনারের মামলাগুলোকে দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনে ১৯৯৪ সালে প্যানেল কোড সংযোজনের মাধ্যমে আধা-ফৌজদারি হিসেবে পরিণত করা হয়েছে।
আদালত বলেন, কনট্রাকচ্যুয়াল অব নেগোসিয়েশন বা চুক্তিগত দ্বায়-দায়িত্ব পূরণে ব্যর্থতার জন্য কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে বন্দি রাখা যাবে না। চুক্তিগত দ্বায়-দায়িত্ব পূরণে ব্যর্থতার জন্য যদি কারাগারে পাঠানো হয় তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কারাগারে চলে যাবে। এটা কারো কাম্য নয়।
আদালত মনে করেন, নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের ১৩৮ ধারা দ্রুত সংশোধন করে কারাগারে পাঠানোর বিধান বাতিল করা আবশ্যক। আদালত প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, জাতীয় সংসদ অতি দ্রুত নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের ১৩৮ ধারা সংশোধন করবে। আদালত বলেন, জাতীয় সংসদ যতদিন না ১৩৮ ধারার সংশোধন না করেন বা সংশোধনী আনা হয়, ততদিন পর্যন্ত নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের ১৩৮ ধারার আওতায় চেক ডিজঅনারের মামলা আপসযোগ্য হবে। চেক ডিজঅনারের মামলা বিচারের এখতিয়ার সম্পন্ন দেশের সব আদালতে সাজার পরিবর্তে তিনগুণ পর্যন্ত জরিমানা দিতে পারবে। আদালত এই রায়ের অনুলিপি দেশের সব আদালতে ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গতকাল রোববার দেয়া এই রায়ের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র এডভোকেট ড. কাজী আকতার হামিদ বলেন, চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলা নিয়ে হাইকোর্ট যে রায় ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন এটি যুগান্তকারী। এই রায় বাস্তবায়ন করা হলে চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলা এখন দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
তিনি বলেন, ব্যবসা বা কোন আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি পর্যায়ে, সমবায়-সমিতি, বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক-বীমায় গ্যারান্টি হিসেবে চেক প্রদান করা হয়। সেই চেক ডিসঅনার করে চেক গ্রহীতা চেকদাতার বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানির অসংখ্য নজির রয়েছে আমাদের দেশে। রায়টির ফলে এই ধরনের হয়রানি এখন লাঘব হবে। এ রায়ের ফলে আদালতে মামলা জটও অনেকাংশে কমে আসবে।
আদালতে বাদীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আশরাফুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মো. আশেক মমিন।
ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আশেক মমিন সাংবাদিকদের জানান, এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদকে পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি অভিমত দিয়েছেন আদালত।
আদালত বলেছেন, এনআই অ্যাক্টের মামলায় বিশেষ করে চেক ডিজঅনারের মামলায় কাউকে জেলে পাঠানো সংবিধান পরিপন্থি। আদালত ধারাটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এসব মামলা নিষ্পত্তিতে একটি নীতিমালা করে দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটি থাকবে বলেও জানিয়েছেন আদালত।