বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতির মাধ্যমে দেশে ৮০ ভাগ পানি দূষণ রোধ সম্ভব

বাংলাদেশের প্রায় ৭৩ শতাংশ জনগণ অনিরাপদ পানি পান করছে। এক্ষেত্রে বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি ব্যবহার করলে ৮০ ভাগ পানি দূষণ রোধ করা সম্ভব।

সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন সারাদেশে নিরাপদ পানি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। সবুজ আন্দোলন গবেষণা পরিষদ দীর্ঘ ৮ মাস সিটি কর্পোরেশন এরিয়া ও উপকূলীয় অঞ্চলে সংগঠনের বিভিন্ন নেতা কর্মীদের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।

সবুজ আন্দোলনের ৪র্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ২য় তলায় জহুর হোসেন চৌধুরী হলে “পানি দূষণ রোধে সরকার ও জনগণের করণীয়” শীর্ষক আলোচনা সভা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন ও ‘গ্রীনম্যান অ্যাওয়ার্ড—২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে বাপ্পি সরদার বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও জনগণ তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না। পানি দূষণের ফলে বাংলাদেশের জনগণ সব থেকে ভোগান্তিতে রয়েছে। সিইটিপি পদ্ধতি ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোন কল কারখানায় তা মানছে না। সরাসরি নদীতে বর্জ্যগুলো প্রবাহিত হওয়ার ফলে জলজ প্রাণীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে পানি দূষণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি হতে পারে মুক্তির উপায়।

বাইবাস ক্যানাল পদ্ধতি হচ্ছে, একই অঞ্চলে অবস্থিত ১০-২০টি কারখানাকে একটি ছোট মৌজা তৈরি করে মিনি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ব্যবহারের মাধ্যমে পানিকে দূষণমুক্ত করা যার ফলে ১ লিটার পানি শোধন করতে ২—৩ টাকা খরচে নামিয়ে আনা সম্ভব।

তিনি বলেন, এশিয়া অঞ্চলে সব থেকে নিরাপদ পানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ভূ—গর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকা এবং দেশের ২১ টি জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ও সুপেয় পানি ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে। দেখা গেছে শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে বসবাসরত জনগণ শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করছেন। ঢাকা সিটির ওয়াসার পানিতে আয়রন, ক্যাডমিয়াম, মিনি প্লাস্টিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা দেখা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে যা প্রচার করা হয়েছে। আমাদের মতে উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৭৭ শতাংশ জনগণ অনিরাপদ পানি পান করার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। উঠতি বয়সী কিশোর কিশোরীরা কম পানি পান করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যান্সার এবং বন্ধ্যাত্ব রোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৮০ শতাংশ জনগণ পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ফসলি জমি, পুকুর ও নদীতে ঢুকে পড়ায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ শতাংশ লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ২০৫০ সালে সারা বাংলাদেশে খাবার পানি ও সেচের পানির জন্য মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ সংকটে পড়বে।

জরিপ করে দেখা যায়, সারা বাংলাদেশে বর্তমানে সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনগণ। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য প্রতি লিটারে ৪ টাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১ টাকার অধিক গুনতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ খনন করতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মিটার গভীরে যেতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে।

সারা পৃথিবীতে উন্নত রাষ্ট্র অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ও মিথেন গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে যার ফলে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের তলদেশে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের সময় পানির তীব্রতা, উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জল ও মাটি দূষণ এবং নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি পানি দূষণ জনিত জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনগণ। বিশেষ করে চর্ম রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে ২১ জেলায় স্বাদুপানির এলাকা ৫০ ভাগ থেকে কমে ৩৪ ভাগ হয়েছে। মৃদু লবণাক্ত এলাকা ৫২ ভাগ থেকে কমে ৪৬ ভাগ হয়েছে। যা আগামীতে প্রচন্ড লবণাক্ত এলাকা ৪ ভাগ থেকে বেড়ে ২০ ভাগে রূপান্তরিত হবে। বর্তমানে ৩০ বছরে ১০ ভাগ এলাকা ও ১০ ভাগ তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

নিরাপদ পানি ব্যবস্থা জোরদার করতে সবুজ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়:

১) ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের সংশোধন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জনসচেতনতার জন্য প্রচার—প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।

২) সারা বাংলাদেশে নদীর নাব্যতা সংকট দূরীকরণে সকল নদী খননের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সমুদ্রের সাথে নদীর গতিপথকে সচল রাখতে হবে।

৩) বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে সমুদ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যার ফলে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের পানি সংকট দূর করা সম্ভব।

৪) নদীতে কলকারখানার বর্জ্য অপসারণ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ইটিপি ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাইপাস ক্যানাল পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং প্লাস্টিক পণ্য নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫) নদীর ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী বেড়িবাঁধ, ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করা, জাহাজভাঙা শিল্প বর্জ্য অপসারণের সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করা, জাহাজ ডুবি রোধে ফিটনেসবিহীন নৌযান ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

৬) উপকূলীয় অঞ্চলে সরকার ও উন্নয়ন অংশীদার প্রকল্প জোরদার করা। যার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি এবং সুপেয় পানির নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।

৭) ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সভা সেমিনার ও সমাবেশের ব্যবস্থা করা এবং পরিবেশ কর্মীদের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্টেকহোল্ডার বডি তৈরি করতে সচেষ্ট হতে হবে।

৮) মাটির উর্বরতা ধরে রাখতে কেমিক্যাল স্যারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করা, উন্নত বীজ,সার ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার যন্ত্রাংশ সরবরাহে সরকারের পক্ষ থেকে যথা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯) উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য মিনি হাসপাতাল নির্মাণ এবং নিরাপদ পানি ব্যবহারের গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বর্তমান সরকার উন্নয়ন করছে তবে পরিবেশ উন্নয়নের দিকটি ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। সবুজ আন্দোলনের কার্যক্রমের সাথে আমি একাত্মতা ঘোষণা করছি। নদী দূষণরোধে সরকারকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডফান্সড স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আতিক রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ মঞ্জুরুল কিবরিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক যুগ্ম সচিব মোঃ জাহিদুল হক সরদার, মেডিসিন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সাকিরা নোভা, নদী অধিকার মঞ্চের সমন্বয়কারী শমসের আলী, অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মেজবাহ উদ্দিন মোহাম্মদ স্বপন জীবন চৌধুরী। আরও বক্তব্য রাখেন সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের মহাসচিব মহসিন সিকদার পাভেল, অর্থ পরিচালক নিলুফার ইয়াসমিন রুপা, পরিচালক অধ্যক্ষ নাদিয়া নূর তনু, শেখ এনামুল হক রনি। সঞ্চালনা করেন সবুজ আন্দোলনের পরিচালক অভিনেতা উদয় খান।

অনুষ্ঠানে মৌলিক উদ্ভাবনী, পরিবেশগত গবেষণা, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে ধারাণাপত্র তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) এর নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান, হালদা নদীতে মাছের প্রজনন রক্ষা ও পানি দূষণ রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ মঞ্জুরুল কিবরিয়া, পরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০০ প্রজাতির গাছ ৩৮ হাজার বৃক্ষরোপন করে সবুজ ক্যাম্পাস তৈরিতে ভূমিকা রাখায় অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, পরিবেশ বিপর্যয় রোধে জনসচেতনতা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় আরটিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার মাইদুর রহমান রুবেল, ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট শাহরিয়ার অনির্বাণ, মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার জাহেদ সেলিম ও সময় টিভি’র এসোসিয়েট সিনিয়র রিপোর্টার মার্জিয়া হাশমি মুমু কে এ বছর গ্রীনম্যান অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।

সূত্র: মো. সোহেল রানা, দপ্তর সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts